বৈশাখের নতুন ঘটনা ও বিতর্কপ্রাণ বাংলাদেশ

বৈশাখ নিজেই নতুন ঘটনা। বৈশাখী উৎসব তো আরও নতুন। নতুন বলেই বিতর্কপ্রাণ বাংলাদেশে এ নিয়ে তাজা বিতর্ক এখনো চলমান। একদল বলেন, বাংলা নববর্ষ আসলে ইংরেজি নববর্ষের নকল। আরেক দল বলেন, পয়লা বৈশাখ ছিল ব্যবসায়ীদের দিন। আরেক পক্ষের মত, পয়লা বৈশাখ নয়, বরং চৈত্রসংক্রান্তিই আমাদের আসল ঐতিহ্য। এই তিন পক্ষের কথাই ঠিক। পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ আজকের চেহারায় ছিল না একসময়। এটা আমাদের নতুন ঐতিহ্য এবং এটা সৃষ্টি করা হয়েছে।

এটুকু মেনে নিলেই তাঁরা বলে উঠবেন, যা কিছু বহুকাল থেকে চলে, তা-ই তো ঐতিহ্য। ঐতিহ্য তো পুরাতনি ব্যাপার, সেটা আবার সৃষ্টি করা যায় নাকি? ঐতিহ্য পুরাতনও বটে, কিন্তু কোনো কিছু নতুন করে রেওয়াজ হয়ে গেলে সেটাও নতুন ঐতিহ্য হয়ে উঠতে পারে। ঐতিহ্য যে সমকালেও জন্মাতে পারে, বৈশাখী উৎসবের জনপ্রিয়তাই তার প্রমাণ।

উৎসব মূলত তারুণ্যের প্রাণের শক্তিতে বেঁচে থাকে। আর তরুণেরা যুগে যুগে পুরাতনের মধ্যে নতুনকে মেশায় বলেই পুরাতনও বেঁচে থাকে নতুনের মধ্যে। বাংলা বর্ষবরণের চরিত্রও এভাবে বিবর্তিত হয়েছে। ছায়ানট যদি ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের দরকারে গভীর বাংলায়ন চালিয়ে থাকে, তবে পয়লা বৈশাখে এখন চলে সহজ ও হালকা ‘বাঙলামি’।

বাঙালিয়ানা একটু ওপরতলার রুচিমানদের সংস্কৃতি। বাঙলামি তারুণ্যের সহজ ছন্দের মতোই হালকা ও এজমালি ব্যাপার। উৎসব যত সহজ ও সপ্রাণ আনন্দের আমেজ দেবে, ততই তা জনপ্রিয় ও স্থায়ী হবে। বাঙালিত্ববাদ যদি ধর্ম না হয়ে থাকে, তাহলে তার আরও গণমুখী ও চলনসই হতে দোষ কী? কী দোষ গ্রামীণ ঐতিহ্যের সঙ্গে শহুরে ঢঙের ঝিলিমিলি মিলে গেলে?
বাঙালিপনাকে উচ্চকোটির ঠাটবাট কমিয়ে সংস্কার করে নেওয়ার জরুরত ছিল। ভাব ধরে থাকলে সনাতন বাঙালিপনা জাদুঘরবাসী হয়ে পড়ার ভয় থাকে। বাঙালিত্ব নবায়নের এই গুরুদায়, অতএব, বাংলা নববর্ষের ঘাড়েই বর্তায়। কৃষকের চৈত্রসংক্রান্তিকে আত্মসাৎ করে, বণিকের হালখাতা আর জমিদারের কর আদায়ের পুণ্যাহর গা থেকে শোষণচিহ্ন মুছে, ইংরেজি বর্ষবরণের আমেজে নতুন এক উৎসব জন্মাল। আদলে গ্রামীণ কিন্তু স্বভাবে রীতিমতো শহুরে এই ফেস্টিভ্যাল। এই নাগরিক ‘বাঙলামি’ বা নাগর ‘বাঙলামি’ ঢাকাই মধ্যবিত্তের অবদান। এটা কিষান-কিষানির সোনাবন্ধুকে আর চায় না, চায় শহুরে জিনস-ফতুয়া-পাঞ্জাবি-শাড়িশোভিত মডার্ন ‘ফ্রেন্ডস’। তাহলেও ঢাকাই মধ্যবিত্তের এই নতুন ট্র্যাডিশন গ্রাম-মফস্বল ও নিম্নশ্রেণির তরুণ-তরুণীদেরও মজায়। কারণ, এটা হালকা ও বিপণনযোগ্য। বাজার ও যুগের হাওয়া এর পক্ষে।

কেউ কেউ বলে থাকেন, বাংলা নববর্ষ হিন্দুয়ানি কালচার। প্রথমত, বৈদিক নববর্ষ বৈশাখে শুরু হতো না, তা হতো অগ্রহায়ণ মাসে। দ্বিতীয়ত, বৈশাখকে বছরের প্রথম মাস ধরে সনগণনার নিয়ম চালু করেন মুঘল সম্রাট আকবর, কর আদায়ে শৃঙ্খলা আনার উদ্দেশ্যে। ভারতীয় শকাব্দ ও আরবি হিজরি মাসকে বৈজ্ঞানিকভাবে মিলিয়ে তিনি তারিখ-এ ইলাহি নামে এই ক্যালেন্ডার চালু করেন। এ কাজের ভার দিয়েছিলেন সেকালের বিশিষ্ট ইরানি জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতুল্লাহ শিরাজির ওপর। হিজরি চান্দ্রবর্ষপঞ্জিকে ভারতীয় সৌরবর্ষপঞ্জিকার সঙ্গে মেলান শিরাজি। বাংলা সন ও হিজরি সনকে এ কারণে কাছাকাছি থাকতে দেখা যায়।

তৃতীয়ত, পয়লা বৈশাখের এই দিগ্‌বিজয় বাংলাদেশে যত, পশ্চিমবঙ্গে তত নয়। পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘বেহালখাতা খোলার দিন’ শিরোনামে লেখক শিশির রায় আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘পড়শি রাষ্ট্র যখন পয়লা বৈশাখ দিনটাকে রীতিমতো ঢুকিয়ে নিয়েছে হৃদয়ে-রক্তে, বৈশাখী উৎসবকে রূপ দিয়েছে একটা জাতিসত্তার “কার্নিভাল”-এ, গঙ্গার এপারে আমরা তখন হুজুগে বাঙালিয়ানার দেখনদারির মোচ্ছবে আকুল।’ অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের বর্তমান রূপটা খাঁটি বাংলাদেশি জিনিস। এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের মতো খিচুড়ি না খেয়ে পান্তা-ইলিশ খাওয়াটাই বাঙালিপনার সঙ্গে বেশি যায়। এবং এতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ঐতিহ্যেরই ছাপ আছে।

বর্ষবরণ বিশ্বের সব হিন্দু-মুসলমান বাঙালির মিলনের রাখীবন্ধনের দিন। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান আমজনতা এই উৎসবকে নিজের করে দেখিয়ে দিয়েছে তারা মুসলমানও বটে, বাঙালিও বটে। তবে তাদের বাঙালিত্বটা আরেকটু সরেস ও লোকমনা। গত শতকের প্রথমভাগের চিন্তাবিদ বিনয় সরকারের কথা ধার করে একে বলতে চাইছি ‘বাঙলামি’।

ছাপাখানা ও সংবাদপত্র একসময় জাতীয় চেতনা তৈরিতে সাহায্য করেছিল। আধুনিক জাতীয়তাবাদের বিকাশে প্রিন্ট ক্যাপিটালিজমের মুখ্য ভূমিকার কথা বলেছিলেন বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন। সেটা ছিল প্রথম আধুনিক/ শিল্পবিপ্লব/ সলিড মডার্ন যুগের ঘটনা। সে সূত্রে এখনকার ইলেকট্রনিক মিডিয়া ক্যাপিটালিজমের যুগের জাতীয়তাবাদ গড়ন-গঠনে উত্তরাধুনিক/ লিকুইড মডার্ন ইত্যাদি না হয়ে যায় কই? জাতীয়তাবাদের ভেতর থেকে রাজনৈতিক শাঁসটা সরিয়ে একে সংস্কৃতিচর্চা ও উৎসবের বিষয়ে পরিণত করা এই মিডিয়াজাত বাস্তবতার ভূমিকা ব্যাপক। ডিজিটাল মিডিয়া ছাড়া বাংলা বর্ষবরণ বিশ্ববাঙালির উৎসব হয়ে ওঠা কঠিন ছিল।

ইলিশ নিয়েও খুঁতখুঁতে হওয়ার কিছু নেই। ইলিশের বংশবিস্তারের ক্ষতি না করে ইলিশ খাওয়া গেলে ক্ষতি কী? সংস্কৃতি নতুন হবে, অভ্যাস বদলাবে, এটাই নিয়ম। সংস্কৃতি আর প্রকৃতি এ জন্যই আলাদা। সংস্কৃতি কথাটার মধ্যে সংস্কার তথা গড়েপিটে নেওয়ার ব্যাপার আছে। তার মধ্যে গ্রহণ-বর্জনের স্বভাব আছে, নতুন হয়ে ওঠার তাড়না আছে। এটা জোরাজুরির মামলা না। অতীতে পয়লা বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না তাতে কী? অতীতে তো পয়লা বৈশাখই বড় আকারে উদ্‌যাপিত হতো না। সংস্কৃতি ও উৎসব নদীর মতো, তা জনমানুষের আপন চাহিদায় চলে। এটা পণ্ডিত ও পুলিশের শাসানি মানে না।

যাঁরা পয়লা বৈশাখকে শহুরে মধ্যবিত্তের আয়োজন বলে দূরে রাখতে চান, কিংবা ফিরতে চান চৈত্রসংক্রান্তিতে, তাঁদের উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু চাইলেও সবাই গ্রামে ফিরতে পারবে না। গ্রামও যোগাযোগ ও টেলিভিশনের বরাতে দ্রুতই বদলে যাচ্ছে। তা ছাড়া মধ্যবিত্তের হাত দিয়ে বাংলাভাষী সবার জন্য একই উৎসবের জয়যাত্রা চালু হওয়া তো আরও ভালো ব্যাপার। বিশ্বায়নের ঢলে ভেসে যাওয়ার চাইতে বাঙলামিতে মেতে ওঠা হিন্দি ও ইংরেজির দাপট থেকে বাঁচতেও কাজে লাগছে। সেই কাজেই বর্ষবিদায়ের চৈত্রসংক্রান্তি আর বরণের পয়লা বৈশাখ মিলে গিয়ে এক উৎসব হওয়াই ভালো।

রাষ্ট্র বাঙালিত্বের জন্ম দেয়নি, বরং বাঙালিত্বই রাষ্ট্রকে পয়দা করেছে। বাঙলামি প্রসারের ধর্মপিতাও রাষ্ট্র নয়। সব সমালোচনা সত্ত্বেও এই উৎসবের জন্ম সমাজের আয়তনে, তরুণদের উদ্যমে। বিদেশি সংস্কৃতির চাপের মুখে দেশি সংস্কৃতির প্রসারে এর সম্ভাবনা ব্যাপক। বৈশাখের এই এক থেকে বহু হয়ে ছড়িয়ে পড়া নতুন ঘটনা এবং এ ঘটনা ঢাকাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত সমাজেরই অবদান। এই ঘটনা রক্ষণশীল শুদ্ধতাবাদ এবং আগ্রাসী সাংস্কৃতিক ভাইরাসকে দমিত রাখতেও কাজে লাগবে। ঢাকাই মধ্যবিত্ত শত অসংগতি সত্ত্বেও নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টির ক্ষমতা যে ফুরিয়ে ফেলেনি, এটাই নতুন সংবাদ। কিন্তু এই সক্ষমতাকে মাটির আরও কাছে, মানুষের আরও ঘনিষ্ঠ হতে হবে।
বাঙলামি টিকে থাকুক। সবাইকে শুভ পয়লা বৈশাখ।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment