হাসপাতালের মেঝে-বারান্দায় রোগী,‘স্বাস্থ্যসম্মত নয়, দৃষ্টিকটু’

ঢাকা মেডিক্যাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল ও রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ রাজধানী ও দেশের বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালেই রয়েছে বেড সংকট। এ কারণে হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায় থেকেই চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন রোগীরা। তবে মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নেওয়াটা যেমন রোগীর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত নয়, তেমনই এটা দৃষ্টিকটু ও অশোভন।

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায় ভর্তি হয়েছেন মিরপুরের বাসিন্দা আব্দুল করিম (৫২)। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে এসেছি। কোনটা বারান্দা আর কোনটা মেঝে, তা দেখলে তো চলবে না। রোগ হয়েছে এখন সারাতে হবে।’

অপর এক রোগী সালমা বেগম (৬৩) বলেন, ‘হাসপাতালে আসার পর আমার ছেলে বেড পাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছে, পায়নি। তাই বাধ্য হয়ে মেঝেতেই আছি।’

তবে রোগীদের হাসপাতালের মেঝেতে ও বারান্দায় থেকে চিকিৎসা নেওয়াটা মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয় বলে দাবি করছেন খোদ কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। তাদের মতে, এভাবে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। পাশাপাশি অসুস্থ রোগীদের হাসপাতালের আরও বিভিন্ন জীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

রোগীদের মেঝেতে থাকার বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই হাসপাতালে ৮৫০টি বেড আছে। কিন্তু রোগী ভর্তি আছে দ্বিগুণেরও বেশি। দেখা যায়, একটা ওয়ার্ডে ৬০টি বেড রয়েছে। সেখানে বাইরে মেঝেতে আছে আরও প্রায় ১০০ জন। রোগীদের তো আর আমরা ফেরত পাঠাতে পারি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। এই বিষয়টিতে সরকারের নজর দেওয়া দরকার। শুধু বেড বাড়ালেই রোগীরা সুচিকিৎসা পাবে তা না। সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে আরও চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। সাড়ে তিনশ’ বেডের জনবল দিয়ে এখানে চিকিৎসা চলছে। কিন্তু রোগীর সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। ফলে ভালো সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এটা অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের বিবেচনা করা দরকার ।’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাছির উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই হাসপাতালে ২৬০০ বেড রয়েছে। কিন্তু যে জনবল রয়েছে তা দিয়ে ১৬০০ জন রোগীকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। দেখা যায়, আমাদের সব বেডে রোগী থাকলেও অন্তত ১২০০ রোগীকে সব সময় মেঝেতে থাকতে হয়।’

তিনি আরও বলেন,‘আমার এখানে কোনও রোগী আসলে আমি অবশ্যই নেবো। কারণ, না নিলে তিনি মারা যাবেন। এনআইসিভিডি, নিটোর, কিডনি হাসপাতাল, চক্ষু হাসপাতালসহ অন্য হাসপাতালে দুপুর ২টার পর আর ভর্তি নেওয়া হয় না। তখন রোগীরা ঢাকা মেডিক্যালে আসে। এসময় বেড ফাঁকা না থাকলেও রোগী ভর্তি করতে হয় এবং চিকিৎসা শুরু করি।’

তিনি বলেন, ‘মেঝেতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগীর কষ্ট হয়। আমাদেরও চিকিৎসা দিতে বেগ পোহাতে হয়। তারপরও মানবিক বিবেচনায় আমরা চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি।’

ঢামেক পরিচালক বলেন,‘আমাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা মেডিক্যালকে পাঁচ হাজার শয্যার আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল করার অনুমোদন দিয়েছেন। আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করছি। পূর্বাচলসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের তিনটি শাখা নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। এগুলো হলে রোগীদের সমস্যা অনেকাংশে লাঘব হবে।’

ঢাকা মেডিক্যালের সিনিয়র চিকিৎসক ডা. চিন্ময় দাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের সমাজ বৈষম্যমূলক। চিকিৎসাক্ষেত্রেও এই বৈষম্য আছে। এত অগোছালো পরিবেশে চিকিৎসা হতে পারে না। চিকিৎসা মনোযোগের বিষয়। তা নিশিচতে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে।না হলে এই অব্যবস্থাপনা দূর করা যাবে না।’

মেঝেতে রোগী রাখার বিষয়ে হেলথ রাইটস মুভমেন্টের প্রেসিডেন্ট ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘মেঝেতে রোগী থাকার বিষয়টি শোভন নয়। এটি পৃথিবীর কোনও সভ্য দেশে থাকে না। স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনের তুলনায় কম বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর প্রভাব রোগীর ওপর পড়ে। জিডিপির মাত্র একভাগ চিকিৎসার জন্য খরচ হয়। এ দিয়ে রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত হয় না। বেসরকারি হাসপাতালেও কোনও রেগুলেটরি বডি না থাকায় সেখানেও চিকিৎসার অবস্থা ভালো নয়। রোগীর সুচিকিৎসার জন্য বর্তমান ম্যানেজমেন্ট বদলাতে হবে। সরকারকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে আরও বাজেট বাড়াতে হবে।’

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment