আনন্দের মধ্যেও নিরানন্দ রয়ে গেল খালেকের জীবন

আনন্দের মধ্যেও নিরানন্দ রয়ে গেল খালেকের জীবন

মোঃ রাসেল দেওয়ান চাঁদপুর প্রতিনিধি 

শীতের সকাল, কনকনে ঠান্ডার পর মিষ্টি রোদ উঠেছে, ফরিদগঞ্জ-রায়পুর সড়কের ডাকাতীয়া নদীর উপর নির্মিত ব্রীজের মাজার রোডের সোহেল মিয়ার দোকানে বসে চায়ে চুমুক দিতেই দেখি একজন বয়স্ক লোক তাকিয়ে আছেন। ডাকতেই কাছে এলো জিজ্ঞেস করলাম চা খাবেন? লজ্জা পেয়ে বললো না! অনুরোধ করতেই বললেন ঠিক আছে দেন। চা খেতে খেতে আলাপ…

বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলার ঘর বাড়ী সাজাতে যার বানানো কাগজের ফুল শোভা পায়, খোকা খুকিদের মনে আনন্দ দিতে যে লোকটি ফুল, চরকা, কাগজের কলস বা বিভিন্ন খেলনা বিক্রি করে চলেছেন বিগত দুই যুগ ধরে। অথচ নিজের বাড়ী এমনকি সংসারটিও ঠিকমত সাজাতে পারেনি তিনি, নিরানন্দ রয়ে গেল নিজের জীবন।

ফুল লাগবে ফুল ? আরো আছে হরেক রকম খেলনা। এমন হাক ডাক দিয়ে সারদিন এ পাড়া থেকে ও পাড়া ঘুরে বেড়ান সত্তরোর্ধ আব্দুল খালেক। হাটতে হাটতে এক সময় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে অচেনা কোন এলাকার গাছের ছায়ায় একটু জিরিয়ে নেন।

অদুর থেকে চায়ের স্টলে বসা অপরিচীতদের চা বিস্কিট খাওয়া দেখে নিজেরও কিছু খেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু ইচ্ছের বিরুদ্ধে পকেটে হাত গেলেও সাবধান হয়ে নিজের ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিতে হয় আব্দুল খালেকের।

এ ফুল কোন সুগন্ধ ছড়ায় না। তবে সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে পরিপূরক হিসাবেই কাজ করে। সেই ফুলের ফেরিওয়ালা সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ আব্দুল খালেক। বাংলাদেশের নওঁগা জেলায় বাড়ি। শৈশব-কৈশর ন্ওঁগার মাটিতে কাটালেও এখন জীবন যুদ্ধে নেমে তাকে ঘুওে বেড়াতে হচ্ছে বাংলার আনাচ-কানাচ।

চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ-চাঁদপুর ডাকাতিয়া ব্রীজের সন্নিকটে মাজার রোডের একটি চায়ের দোকানের অদুরে গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম করছিলেন। একটি ছবি তুলবো বলতেই উঠে দাঁড়ালেন। সে সাথে জীবন সংগ্রামের গল্পও বললেন।

বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলায়ই ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। দিনের পর দিন হাঁড়ভাঙা কষ্ট করেছেন স্ত্রী সন্তানদের জন্য। বৃদ্ধ খালেকের পরিবারে স্ত্রীসহ রয়েছে চার মেয়ে। দারিদ্রতা তাঁর কন্যা সন্তানদের শিক্ষিত হতে বাঁধাগ্রস্থ করলেও তিনি তাঁর কন্যাদের বিবাহ সম্পাদনের কাজটি করতে পেরেছেন।

বললেন মেয়েরা স্বামী সন্তান নিয়ে ভালোই আছে। তারা কেউ বড়লোক না কিন্তু সূখী। এ বাক্যটির সাথে হালকা হাসীমাখা মুখখানা দেখে সূখের সংজ্ঞা বুঝতে আমার একটুও কষ্ট হয়নী। শুধু ভাবছিলাম আমরা মধ্যবিত্তরা এবং এ দেশের বড়লোকরা কোন সুখের নেশায় ছুটছি। আমাদের সুখের সংজ্ঞা আব্দুল খালেকের প্রকাশিত সুখের সংজ্ঞার মধ্যে এত তফাৎ কেন?

তাঁর জীবনের গল্পটা খুব সুখকর নয়। রোজ ভোরে বেড়িয়ে পড়তে হয় ফেরি করার কাজে। তবে অন্য দশজনের মত তাঁর ফেরিটা এক নয়। তিনি ফেরি করেন কাগজের ফুল। রঙ-বেরঙের বাহারী রকমের ফুল ও খেলনার সমাহার তার কাছে রয়েছে। সেগুলো তিনি একেকটা একেক দামে বিক্রি করেন।

ঢাকা, কুমিল্লা, ব্রাম্মনবাড়ীয়া, সিলেট, হবিগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নাটোর, জিনাইদহ সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্যান্ত অঞ্চলে জীবিকার তাগিদে বিচরন করেছেন ইতোমধ্যে। বিভিন্ন এলাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতি, ভাষা, মানুষের চাল চলন সম্পর্কে অনেক ধারনা রয়েছে আব্দুল খালেকের।

এ সমযে তিনি তেমন কোন বিড়ম্বনার স্কীকার হন নি বরং দেশ ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগছে। তবে দুশ্চিন্তা আর অভাব তাড়িয়ে বেড়ায় সর্বক্ষন। সারাদিনে খুব বেশী হলে তিনশত টাকা রোজগার হয়।

মালামাল শেষ হয়ে গেলেই তিনি জায়গা পরিবর্তন করেন। তিনি মনে করেন, নতুন জায়গায় নতুন ক্রেতার দেখা মিলবে। বর্তমানে তিনি অবস্থান করছেন চাঁদপুর জেলায়। এখানে তিনি ১ মাসের জন্য বাসা নেন। খুব ভোরে যখন সুর্য্যি মামা আকাশে উঁকি দেয় তখন তিনি বেড়িয়ে পড়েন কাজে।

বিভিন্ন রঙের কাগজ কিনে এনে তিনি এসব কাগজে শিল্পের ছোঁয়া দেন। দৃষ্টিনন্দন ফুলের তোড়া ও খেলনা তিনি বানান বিক্রির জন্য। এরপর এগুলো কাঁধে করে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেন। নিখুঁত তার এই শিল্পকর্ম পাইকারী ও খুচরা বিক্রি করেন। প্রতিদিন এক হাজার টাকার মত আয় করেন। যার মধ্যে দুই থেকে তিন টাকা লাভ থাকে।


বয়সের কারণে ভারি কোন কাজ করতে না পারার কারণে এই পেশাটিকে বেছে নেন। বৈচিত্রময় এ পেশায় এসে যেমন তিনি কষ্ট পাচ্ছেন আবার তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন।আব্দুল খালেক বলেন, আমি চুরি বা কোন রকম অপরাধ করছি না। কাউকে ঠকাই না এবং হারাম কামাই করি না। তিনি মনে করেন কোন কাজই ছোট নয় যদি তা নিষ্ঠা আর সততার সাথে করা যায়।

আপনি আরও পড়তে পারেন