আপনার ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত সন্তানকে যেভাবে জানাবেন

ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কে সন্তানকে জানানো আসলে কঠিন ও মানসিকভাবে বিহ্বলকারী একটি বিষয়। এখানে ডিভোর্স সম্পর্কে আপনার সন্তানকে অবহিত করার ৮টি উপায় আলোচনা করা হলো।

১. পরিকল্পনা করুন
‘দ্য এ টু জে গাইড টু রেইজিং হ্যাপি’ ও ‘কনফিডেন্ট কিডস’র লেখক এবং মনোবিজ্ঞানী জেন ম্যান বলেন, ‘ডিভোর্স নিতে যাওয়া পিতামারা যে সর্বাধিক প্রচলিত ভুলটি করে তা হচ্ছে, সন্তানকে জানানো যে খুব শিগগির ডিভোর্স হতে যাচ্ছে।’ তিনি যোগ করেন, ‘শিশুদেরকে এ প্রক্রিয়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বিবাদের সঙ্গে জড়ানো উচিত নয়।’ ডিভোর্স না হওয়া পর্যন্ত, থাকার জন্য নতুন বাসস্থানের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত, বাসস্থানটি প্রয়োজনীয় উপাদানে সজ্জিত না করা পর্যন্ত অথবা ছাড়াছাড়ির জন্য একটি নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক না হওয়া পর্যন্ত সন্তানকে এ ব্যাপার জানানো উচিত নয়। ডা. ম্যান বলেন, ‘পরবর্তীতে কি ঘটতে যাচ্ছে বা ডিভোর্স কবে হবে তা শিশুদের জন্য অত্যধিক উদ্বেগ-প্ররোচক। তাদের সামনে একটি সম্পূর্ণ ও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা উপস্থাপন করা প্রয়োজন। যদি মা-বাবারা একত্রিত হয়ে একে অপরকে দোষারোপ না করে তাদেরকে বিষয়টি বলে তাহলে তা সর্বোত্তম হয়। যদি একের অধিক সন্তান থাকে তাহলে তাদেরকে একত্রিত হতে বলুন এবং তাদেরকে আপনাদের সম্পর্কিত সমস্যা একের পর এক বলুন। কোনো সন্তানকে এ বিষয়ে জানিয়ে অন্য সন্তানের কাছে গোপন করাটা ভালো নয়।’

২. সন্তানকে পর্যবেক্ষণ করুন
মনোবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক জে. সিলিও বলেন, ‘ডিভোর্সের খবর সন্তানের সঙ্গে শেয়ার করা পর তারা কি বলে না বলে অথবা তাদের আচরণে মনোযোগ দিন।’ তিনি যোগ করেন, ‘শিশুদের ক্ষেত্রে আচরণ শব্দের চেয়েও জোরালো কিছু বলতে পারে। যদিও অধিকাংশ বাচ্চারা ডিভোর্সের ফলে উদ্ভূত পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। ডিভোর্সের মতো কঠিন ট্রানজিশনে একজন মনোবিজ্ঞানী সন্তান ও পরিবারকে সাহায্য করতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘যদি আপনি লক্ষ্য করেন যে আপনার শিশু কান্নাকাটি, বিষণ্নতা, উদ্বেগ, স্কুলের পারফরম্যান্স হ্রাস, কার্যক্রমে আগ্রহ হ্রাস কিংবা ঘৃণাত্মক বা আবেগগত বিস্ফোরণের মাধ্যমে স্কুলে বা ঘরে আচরণ প্রদর্শন করছে, তাহলে কষ্ট উপশম, অনুভূতি ও চিন্তার ক্রমোন্নয়ন, যোগাযোগ সুগম করতে এবং ভবিষ্যতে সমস্যা এড়াতে কোনো বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন (ইনডিভিজু্য়্যাল থেরাপি এবং ফ্যামিলি থেরাপি উভয়ের জন্য)।’

৩. শিক্ষককে বিচ্ছেদের কথা জানান
আপনি আপনার সন্তানের স্কুল শিক্ষকদেরকে আপনার ডিভোর্স বা সেপারেশন সম্পর্কে জানাতে পারেন। ডা. সিলিও বলেন, ‘আপনার সন্তানের আচরণ এবং একাডেমিক পারফরম্যান্সে কোনো পরিবর্তন সম্পর্কে রিপোর্ট করতে শিক্ষকরা সহায়ক হতে পারে। যদি আপনি বিবাহবিচ্ছেদের কথাটি শিক্ষকদের কাছে প্রকাশ করেন তাহলে আপনার সন্তানের যেকোনো পরিবর্তন তারা বুঝতে পারবে এবং সেই অনুসারে সাড়া দিতে পারবে।’

৪. সন্তানকে বোঝান যে ডিভোর্সের পেছনে তাদের দোষ নেই
ডা. সিলিওর মতে, ‘একটি সাধারণ বিষয় হচ্ছে, শিশুরা তাদের মা-বাবা কেন বিচ্ছিন্ন হয়েছে তার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে।’ তিনি যোগ করেন, ‘তারা ভাবতে পারে যে- যদি আমি আরো ভালো আচরণ করতাম…যদি আমি স্কুলে আরো ভালো করতাম…যদি আমি আমার ভাই/ বোনের সঙ্গে সবসময় ঝগড়া ঝগড়া না করতাম, তাহলে আব্বু-আম্মু আলাদা হতো না। মা-বাবার বারবার বাচ্চাদেরকে নিশ্চিত করা দরকার যে, ডিভোর্সের পেছনে তাদের কোনো দোষ নেই।’ ঘনঘন কথোপকথন ও চেক-ইন বাচ্চাদেরকে অনুভূতি শেয়ার ও প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়। এটা তাদের দেখায় যে তাদের চিন্তাধারা এবং অনুভূতি আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ডা. সিলিও বলেন, ‘শিশুরা প্রকৃতিগতভাবে আত্মকেন্দ্রিক এবং ভাবে যে তাদের চিন্তা ও আচরণের কারণে ঘটনা ঘটে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের দরজা খোলা রাখুন।’

৫. সন্তানের ক্রোধে আহত হবেন না
ডা. ম্যান বলেন, ‘শিশুদের স্বাভাবিক একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ক্রুদ্ধ হওয়া এবং দোষ দেওয়ার জন্য কাউকে খোঁজা।’ তাদের অনভূতিকে স্বাভাবিক হিসেবে নিন এবং নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্কের সঙ্গে তাদের অনুভূতি মিলাবেন না। ডা. ম্যান বলেন, ‘বিবাহবিচ্ছেদকে দোষারোপ না করে তাদেরকে ক্রুদ্ধ ও হতাশ হতে দিন। পিতামাতা উভয়ের জন্য আদর্শ পন্থা হচ্ছে, বাচ্চাদেরকে বোঝানো যে এই ডিভোর্স তাদের দুজনের সর্বোচ্চ স্বার্থ বা সুবিধার জন্য যৌথ সিদ্ধান্তের ফল।’

৬. শিশুদের সহজাত ধারণাকে সহজভাবে নিন
আপনাদের ডিভোর্স সম্পর্কে শিশুরা আভাস দিলেও খুব একটা বিস্মিত হবেন না। ডা. ম্যান বলেন, ‘শিশুরা সজ্ঞানে বা অজান্তে ঘরের অনেক ব্যাপার নিজেদের মধ্যে ধারণ করে। তাদের কাছে ডিভোর্সের বিষয় প্রকাশের আগেই তারা বুঝতে পারে যে বিবাহবিচ্ছেদ আসন্ন।’

৭. সন্তানের সঙ্গে বুদ্ধিমানের মতো কথা বলুন
ডিভোর্স যদি প্রধানত বিবাহবহির্ভূত যৌনসম্পর্কের কারণে হয় তাহলে তা বাচ্চাদেরকে না বলতে ডা. ম্যান পরামর্শ দিচ্ছেন। কেন? ডা. ম্যানের মতে, ‘শিশুদের কাছে একটি সম্পর্কের কথা প্রকাশ তাদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়, এটি প্রচুর ক্রোধ ও দোষ দেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করে। শিশুরা বুঝতে পারে না যে এই সমস্যাসমূহ জটিল। এটি তাদেরকে ভবিষ্যতে কারো সঙ্গে প্রতারণামূলক সম্পর্ক স্থাপনে ধাবিত করবে। এ রকম কামপ্রবৃত্তিমূলক বিষয় তাদেরকে না জানানো ভালো।’

৮. সম্পর্ক বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন
ডিভোর্সের কথা সন্তানের কিভাবে প্রকাশ করবেন তা যদি আপনি এখনো ঠিক করতে না পারেন বা বুঝতে না পারেন, তাহলে একজন রিলেশনশিপ থেরাপিস্টের শরণাপন্ন হোন। ডা. সিলিও বলেন, ‘পিতামাতা যদি বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়ে মনস্থির করেন, তাহলে সন্তানের প্রতিক্রিয়ায় উপযুক্ত সাড়া দিতে এবং তাদের বিকাশ ও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিভোর্স বিষয়ে কিভাবে, কখন ও কি বলবেন তার পরামর্শ পেতে কোনো মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলা উচিত।’ তিনি যোগ করেন, যদি পিতামাতার সমস্যা হয় এবং ডিভোর্স আসন্ন হয় তাহলে থেরাপি গ্রহণের সময় বাচ্চাকে সঙ্গে নেওয়া উচিত নয়।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment