আবারও বাড়লো বিদ্যুতের দাম

Brand Bazaar

এ কথা অনস্বীকার্য, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিরূপ প্রভাব পড়বে জনজীবনে। ডিসেম্বর থেকে প্রতি মাসে নতুন করে বাড়তি টাকা গুনতে হবে ভোক্তাদের। গত ২৩ নভেম্বর বিইআরসি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়ার পর থেকে সারাদেশেই এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেক নাটকের পর আবারও বাড়ল বিদ্যুতের দাম। এবার বিদ্যুতের দাম ৫.৩ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণায় গত ১ ডিসেম্বর থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের অনুকূলে ৩৫ পয়সা বাড়বে, যা হতদরিদ্র জনগণের ওপর ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসাবেই দেখা দেবে। বর্তমান সরকার ইতিমধ্যেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলেছে।

 

কারণ বর্তমান সরকারের আমলে সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে- যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এমনিতেই দেশের বাজার পরিস্থিতি চরমে উঠেছে। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লেও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। কয়েক মাস ধরেই বাড়ছে চালের দাম। চালের দাম বাড়ার যে গতি তার নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। এর পেছনে কার বা কাদের কারসাজি ছিল বা আছে, তা এখন আর কারো অজানা নয়। কিন্তু সরকার চাল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে আটার দামও বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। সবজির দাম জনসাধারণের নাগালের বাইরে অনেক দিন থেকেই, যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। মূলত দেশের বাজার পরিস্থিতি এখন রীতিমতো জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। যদিও সবজির বাজার এখন কিছুটা নিম্নমুখী। দ্রব্যমূল্যের এই আকাশচুম্বী হওয়ার বিপরীতে সাধারণ মানুষের আয় কি বেড়েছে? এমন প্রশ্নের সদুত্তর মেলা কঠিন। এমতাবস্থায় নিকট অতীতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। অন্যদিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিটের দাম ১০.৬৫ শতাংশ বা ৭২ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য আয়োজিত ধারাবাহিক গণশুনানির দ্বিতীয় দিনে প্রস্তাবগুলো করা হয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্টমহল লোকসানের অজুহাত তুলেছে, যা বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না। তারা বলছেন, বর্তমানে ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে ঘাটতি থাকায় প্রতি ইউনিটে ৩ শতাংশ হারে লোকসান দেয়া হচ্ছে। শুধু ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এ কারণে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে প্রতি ইউনিট পাইকারি বিদ্যুতের গড় সরবরাহ ব্যয় ৫ টাকা ৫৯ পয়সা। অথচ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের হিসাবে পিডিবি পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৪ টাকা ৮৭ পয়সায় বিক্রি করে। এতে দেশের একক পাইকারি বিদ্যুৎ ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান পিডিবির ইউনিট প্রতি আর্থিক লোকসান ৭২ পয়সা। চলতি অর্থবছর বা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পিডিবি পাইকারি বিদ্যুতের প্রাক্কলিত সরবরাহ ব্যয় ধরেছে ইউনিট প্রতি ৫ টাকা ৯৯ পয়সা। এ হিসাবে ইউনিট প্রতি লোকসান ১ টাকা ৯ পয়সা। এই বিপুল আর্থিক ক্ষতি সমন্বয় করার জন্যই পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো উচিত বলে মনে করছেন তারা। অন্যদিকে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অযৌক্তিক মনে করছেন। তারা বলছেন, পিডিবি যেসব ব্যয় বিবেচনা করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে তার কোনো ভিত্তি নেই। আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি দামে তেল কিনে, ভর্তুকিকে লোন বিবেচনা করেও ব্যয়বহুল জ¦ালানি ব্যবহারের মাধ্যমে রাজস্ব ব্যয় বাড়িয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তাদের মতে, বাড়তিও অযাচিত ব্যয় বাদ দিলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিবর্তে কমবে। বিদ্যুৎ খাতে লোকসান কমানোর উদ্দেশ্যে বারবার গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর যুক্তি মোটেই বোধগম্য নয়। সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিদ্যুতের বিল বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা অনাদায়ী রয়েছে। সেসব অর্থ আদায় করে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা কেন নেয়া হয় না, এমন প্রশ্নও জনমনে রয়েছে। বছর শেষে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সাধারণ মানুষকে বাড়তি অর্থনৈতিক চাপে ফেলবে।

কারণ নতুন বছরের শুরুতে অভিভাবকদের ওপর সন্তানদের পড়াশোনা বাবদ এমনিতেই বাড়তি খরচের চাপে পড়তে হয়। বিদ্যুতের বাড়তি দামের সঙ্গে সংযুক্ত হলে তা বহন করা আরও কষ্টকর হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। সুতরাং এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোকেই যৌক্তিক বলে মনে করছেন আত্মসচেতন মানুষ। উল্লেখ্য, গত ৬ জুন পিডিবি-বিইআরসির কাছে পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর একটি প্রস্তাব পাঠায়। প্রস্তাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি হিসেবে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কথা বলা হয়, বলা হয় বিদ্যুতের পাইকারি বিক্রয়মূল্য প্রতি ইউনিট ৪.০২ টাকার বিপরীতে ২০১২-১৩ অর্থবছরে সম্ভাব্য সরবরাহ ব্যয় ইউনিট প্রতি ৬.৮৭ টাকা হবে, ফলে ঘাটতি হবে ইউনিট প্রতি ২.৮৫ টাকা। এই ঘাটতি কমানোর জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় পিডিবি। বিইআরসি এ বিষয়ে কথিত গণশুনানি শেষে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ২১.৮৯ শতাংশ বা ইউনিট প্রতি ৮৮ পয়সা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। এই প্রস্তাব কবে থেকে কার্যকর হবে সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য না থাকলেও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী রোজার মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভালো দেখিয়ে রোজার পরে কোনো একদিন থেকে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব কার্যকর করা হতে পারে। কিন্তু সে যাত্রায় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়নি। উৎপাদন মূল্য এবং বিক্রয় মূল্যের মধ্যে ঘাটতি থাকলেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যৌক্তিক কিনা সেই বিতর্কে যাওয়ার আগে দেখা দরকার উৎপাদন মূল্যের ওই বৃদ্ধির কারণ কী এবং তা কতটা যৌক্তিক। পিডিবির প্রস্তাবনা থেকে দেখা যায়, ২০১০-১১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যয় ছিল প্রতি ইউনিট ৪.২০ টাকা ২০১১-১২ সালে ছিল ৫.৪৭ টাকা এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে দাঁড়াবে ৬.৮৭ টাকা। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পেছনে পিডিবির এই খরচ বৃদ্ধির কারণ কী? পিডিবির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবনাতেই স্পষ্ট বলা হয়েছে- তরল জ¦ালানির ব্যবহার, বেসরকারি খাত হতে বিদ্যুৎ ক্রয় এবং জ¦ালানি ব্যয়ের অংশ বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মূলত ডেসকো, ডিপিডিসি, পল্লী বিদ্যুৎ ও পিডিবি এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে দুর্নীতি করার সুযোগ করে দেয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৮ বার পাইকারি এবং খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। নেই কর্মসংস্থান, তাছাড়া শ্রমিকের বেতন বাড়েনি ঠিক এ মুহূর্তে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হলে দেশের মানুষের কষ্ট, দুর্ভোগ বাড়বে। বিশ্বে যখন জ¦ালানি তেলের দাম অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে, তখন বারবার বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গণশুনানির নামে প্রতারণা করেছে। মূলত বিদ্যুতের দাম বাড়ানোকে একমাত্র সরকার ছাড়া অন্য কেউই যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য মনে করছেন না। সংসদের বাইরের বিরোধী দলগুলোর পক্ষে এই দাম বাড়ানোর কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। বামপন্থি দলগুলো হরতাল পর্যন্ত করেছে। তারা বলছেন, ‘বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও জনগণের রক্ত চুষে খেতে আবারও বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। যেখানে বিদ্যুতের দাম কমানোর কথা, সেখানে আগের তুলনায় ৫.৩ শতাংশ দাম বৃদ্ধির ঘোষণা আসায় এখন বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে বাড়বে ৩৫ পয়সা।’ তাদের অভিমত হলো, ‘ব্যাংক, বীমা, শেয়ার বাজারসহ সব অর্থনৈতিক খাতকে তিলে তিলে খেয়ে সরকারের স্বাদ মেটেনি। তাই বারবার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে গরিবের রক্ত পান করাটাই যেন তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। এর আগে গত মার্চ মাসে সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এর আগে ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় বছরে পাইকারি পর্যায়ে ছয় বার এবং খুচরা পর্যায়ে সাত বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। শুধু লুটপাটের জন্যই গরিবের সর্বশেষ সম্বলটুকু আত্মসাৎ করে সরকার আবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে।’ তারা আরও বলেন, ‘বিদ্যুতের সবকিছু সম্পর্কিত। বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বিপাকে পড়বে সীমিত আয়ের মানুষ। শিল্প খাতেও পড়বে এর প্রভাব। এমনিতে সরকারের লুটপাট আর ভয়াবহ দুঃশাসনে দেশে কোনো বিনিয়োগ নেই। এমন সময় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর অর্থ বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করা। এতে গোটা অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে। প্রতিযোগিতা মূল্যে শিল্প উৎপাদন সক্ষমতা ব্যাহত হবে। এ ছাড়া বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পগুলো, রপ্তানি সক্ষমতা, শিল্প বহুমুখীকরণ ব্যাহত হওয়ার পাশা-পাশি ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় বাড়বে। ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান কমবে। দেশে জ্যামিতিক হারে বাড়বে বেকারত্ব। এমনিতেই এশিয়ার সবচেয়ে বেশি বেকারত্বের হারের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। একই সঙ্গে শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যও। বর্তমানে নিত্যপণ্যসহ সবকিছুর দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষ দিশেহারা। তার ওপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মাশুলও দিতে নিম্নআয়ের মানুষদের। কৃষি খাতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে। কয়েক দফা বন্যায় দেশে তীব্র খাদ্য সংকট চলছে, তার ওপর নতুন করে বিদ্যুতের ওই দাম বাড়ায় কৃষি ও শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। সরকার পক্ষ অবশ্য বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিকে যৌক্তিকই মনে করছেন। প্রধানমন্ত্রীর জ¦ালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিকে খুবই সামান্য এবং মামুলি ব্যাপার বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, এই বৃদ্ধির কারণে জনজীবনে কোনো প্রভাব পড়বে না। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, দাম খুব বেশি বাড়ানো হয়নি।
২০০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের এখন থেকে মাসে অতিরিক্ত ২০ থেকে ২৫ টাকা বিল দিতে হবে। গ্রাহক পর্যায়ে যে প্রভাব পড়বে তা সহনীয় বলেই মনে করি। সরকার পক্ষের এমন দাবিকে কোনো পক্ষই যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য মনে করছেন না। কারণ বর্তমান সরকারের আমলেই আট বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এ কথা অনস্বীকার্য, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিরূপ প্রভাব পড়বে জনজীবনে। ডিসেম্বর থেকে প্রতি মাসে নতুন করে বাড়তি টাকা গুনতে হবে ভোক্তাদের। গত ২৩ নভেম্বর বিইআরসি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়ার পর থেকে সারাদেশেই এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment