আলোচনার শীর্ষে পান্তা-ইলিশ, ভুভুজেলা ও বিকেল ৫টার বাধ্যবাধকতা

পহেলা বৈশাখে কোথায় ঘুরতে যাবেন, বা বন্ধুরা কয়টার সময় আড্ডা দেবেন, সে আলাপ যতোটা জায়গা পাচ্ছে তার চেয়ে ঢের বেশি আলাপ চলছে দুপুরের মেন্যুতে ইলিশ থাকবে কিনা, কিংবা ৫টার মধ্যে ঘরে ফিরতেই হবে? সব অনুষ্ঠানই কি বিকেল ৫টার মধ্যে শেষ হবে? এবারের পহেলা বৈশাখকে ঘিরে প্রথমবারের মতো পান্তা- ইলিশ খাওয়া ঠিক কিনা সে আলাপ জোরেশোরে উঠেছে। ১লা মার্চ থেকে ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশের নদীগুলোতে ইলিশ ধরার ওপর মৎস্য অধিদফতরের নিষেধাজ্ঞার ফলে মা ইলিশ বাঁচাতে এই বিতর্ক ওঠারই কথা।

পান্তা ইলিশ

এদিকে বিকট শব্দের ভুভুজেলা থাকবে কি থাকবে না, সে নিয়েও চলছে তুমুল বিতর্ক। বলা হচ্ছে, কেউ বিপদে আর্তচিৎকার করলেও ভুভুজেলার শব্দে তা ঢাকা পড়ে যায়। নিরাপত্তার খাতিরে তা ব্যবহার না করতে আহ্বান  জানিয়েছে পুলিশ। যদিও ইলিশ নিষিদ্ধের মতোই এটাও বিক্রি হচ্ছে যত্রতত্র, দেখার কেউ নেই।

এদিকে কেউ কেউ মনে করছেন দেশে চলমান বড় ইস্যুগুলোকে ধামাচাপা দিতে এই ইলিশ বিতর্ক বেশ কাজের হয়েছে। তারা বলছেন, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বাজারে ইলিশ মাছ প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে ভ্রাম্যমান আদালত যেমন দেখা যায়নি, তেমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টকশো, টেলিভিশনের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর প্রচেষ্টায় ইলিশ যেন ‘জাতীয় শত্রুতে’ পরিণত হয়েছে । কেননা, এই সময়ে ইলিশ রফতানিও বন্ধ নেই, বাজারে মাছ উঠবে ক্রেতা বর্জন করবে, এটা কোনও যুক্তি হতে পারে না।

যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইলিশ রাখেননি পহেলা বৈশাখের মেন্যুতে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, পহেলা বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার সংস্কৃতি দিন দিন বেড়ে চলেছে। এই সময়ে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে ইলিশের দর কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এজন্য সরকারিভাবে পহেলা বৈশাখে ইলিশ না খাওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। তাছাড়া, বর্ষবরণে ইলিশ খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির কোনও অংশ নয় বলেও মত দিচ্ছেন বিশিষ্টজনেরা।

নববর্ষের দিন ইলিশ খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয় বলে এবছর প্রথম সচেতনতামূলক প্রচারণা শুরু করে সময় টেলিভিশন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা এসময় ইলিশ কেন খাওয়া উচিত না আর পান্তা ইলিশ যে সংস্কৃতির অংশও না, সেটা বুঝিয়ে বলেছেন। এরপর ধীরে ধীরে সেটি জাতীয় ইস্যুতে রূপ নিয়েছে। বাজারে  চারটি ইলিশের দাম যখন চল্লিশহাজার টাকা, তখন সচেতন মানুষ আরেকদফা হোঁচট খায়। প্রশ্ন ওঠে, মধ্যবিত্ত পরিবারে আদৌ সৎ উপার্জনে এ খরচ করা সম্ভব কিনা।

ভুভুজেলা

এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন, বৈশাখে পান্তা-ইলিশ করপোরেটের তৈরি করে দেওয়া সংস্কৃতি, যা নব্বই দশকের শুরুতে আবির্ভাব হয়। এখনও গ্রামেগঞ্জে পহেলা বৈশাখ উদযাপন মানে অবস্থাপন্ন এবং ধনী পরিবারে খাবারের আয়োজনে চিড়া, দই, মুড়ি, সাধারণ খই, লুচি, খিচুড়ি, বড় কই মাছ, বড় রুই মাছ ইত্যাদি। আর ৫টার মধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি শেষ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গতবছরের অভিজ্ঞতা থেকে এটা করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এটাকে একেবারে খারাপ বলা যাবে না। নিরাপত্তা বিধান করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরামর্শতো দেবেনই।

উন্নয়নকর্মী চিররঞ্জন সরকার বলেন, বাংলা নববর্ষে পান্তা-ইলিশ খাওয়া উচিত-অনুচিত নিয়ে আকস্মিকই আলোচনার সূত্রপাত। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি নববর্ষে ইলিশ খাবেন না। এদিকে পত্রপত্রিকায় এক হালি ইলিশ চল্লিশ হাজার টাকা, ইলিশের দামে কালবোশেখীর ছোঁয়া ইত্যাদি খবর ছাপা হচ্ছে। এসব আলোচনায় হারিয়ে গেছে, রিজার্ভ চুরির ঘটনা, তনু নামে একটি মেয়ের করুণ মৃত্যু রহস্য, প্রহসনের ইউপি নির্বাচনে প্রায় ৪০ জন মানুষের মৃত্যুর ঘটনা, বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতে গিয়ে বাঁশখালীতে ৪ ব্যক্তির মুত্যু, দেশের পাটকল শ্রমিকদের ন্যায্য হিস্যা বুঝে নেওয়ার দাবি-এমনি অনেক জলজ্যান্ত ইস্যু। প্রশ্ন হলো, যে ইলিশ নিয়ে এত হৈ-চৈ সেই ইলিশ সম্পর্কেইবা আমরা কতটুকু জানি?

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment