ইভ্যালির বিপুল পরিমাণ মোবাইল ফোনসহ বেশ কিছু মালামাল সরিয়ে ফেলেছে কয়েকজন কর্মচারী

ইভ্যালির বিপুল পরিমাণ মোবাইল ফোনসহ বেশ কিছু মালামাল সরিয়ে ফেলেছে কয়েকজন কর্মচারী

ইভ্যালির সিইও ও এমডি গ্রেপ্তারের রাতেই প্রতিষ্ঠানটির ওয়্যারহাউস থেকে বিপুল পরিমাণ মোবাইল ফোনসহ বেশ কিছু মালামাল সরিয়ে ফেলেছে কয়েকজন কর্মচারী। সাভারের হেমায়েতপুরের পূর্বহাটি এলাকায় শ্বশুরবাড়িতে পণ্যগুলো এনে জমা করেন ইভ্যালির প্যাকেজিং সেকশনের দায়িত্বে থাকা মোজাম্মেল। এই পণ্যগুলোর আনুমানিক মূল্য কয়েক কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাতে এ তথ্য জানতে পেরে ইভ্যালির কিছু গ্রাহক অর্ডারকৃত পণ্য বুঝে পেতে সেই বাসার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। পরে তাঁদের দাবিকৃত পণ্য বুঝিয়ে দিতে একদিন সময় চান মোজাম্মেল। সময় পার যাওয়ার পর থেকে মোজাম্মেলের মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে।

হেমায়েতপুরে মোজাম্মেলের শ্বশুর বাড়িতে আনুমানিক ৪০ থেকে ৫০ কার্টন ভর্তি পণ্যের খোঁজ পান আজকের পত্রিকার ধামরাই প্রতিনিধি নাঈম ইসলাম। গ্রাহক সেজে অন্য গ্রাহকদের সঙ্গে ওই বাসায় যান তিনি। তিনি ওই বাসায় ঘরভর্তি পণ্যের কার্টন দেখতে পান। কার্টন খুলে দেখতে চাইলে দুই কার্টন ভর্তি আইফোন ও রিয়েলমি ব্র্যান্ডের মোবাইল দেখতে পান আহাদ নামে একজন গ্রাহক। আজকের পত্রিকার প্রতিনিধির কাছে মোজাম্মেল স্বীকার করেন বাকি কার্টনগুলোতেও মোবাইল ও মোবাইল এক্সেসরিজ রয়েছে।

রোববার মোজাম্মেলের স্ত্রীর বড় বোন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, যেদিন রাসেল গ্রেপ্তার হয় ওই দিন রাত ২টার দিকে একটি মাইক্রোবাস ও একটি লেগুনায় করে পণ্যগুলো তাঁদের বাড়িতে আনা হয়। মানুষ ঝামেলা করতে পারে এই আশঙ্কায় মালগুলো রাতে আনা হয়েছে। পরে শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৩টার দিকে পণ্যগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়। তাঁর দাবি, এ পণ্য আবার ইভ্যালির ওয়্যারহাউসেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পণ্যগুলো বাসায় আনার পর কোন গেট পাশ, স্লিপ বা ক্যাশ মেমো ধরনের কোন কাগজও আজকের পত্রিকার প্রতিনিধিদের দেখাতে পারেননি তিনি।

ওই নারী আরও বলেন, ইভ্যালির মালিকের বড়ভাই ও ওয়্যারহাউসের কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা এসে বাসায় মালগুলো দিয়ে যায়। তাঁরা বলেছিল এখান থেকে মালগুলো বিক্রি করে দেবে। পরে শনিবার বিকেলে বাড়ির ৩ ভাড়াটিয়ার সহযোগিতায় কার্টনগুলো আবারও গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়।

প্যাকেজিং সেকশনের দায়িত্বে থাকা মোজাম্মেলপ্যাকেজিং সেকশনের দায়িত্বে থাকা মোজাম্মেল। ছবি: সংগৃহীত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাভারে মোবাইল ব্যবসায় জড়িত এক যুবক আজকের পত্রিকাকে বলেন, শনিবার ৩০০ ও রোববার ২০০ পিচ রিয়েলমি ৮ (৫ জি) মডেলের ফোন সাভারের বাজারে ছোট হোলসেলারদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে ১৯ হাজার ৭০০ টাকা দরে। হেমায়েতপুর মোজাম্মেলের শ্বশুরবাড়ির এলাকা পূর্বহাটি থেকেই এ ফোনগুলো বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তবে ফোনগুলো কে বুঝিয়ে দিয়েছেন তা জানাতে পারেননি তিনি।

ওই যুবক বলেন, প্রায় ২০ হাজার টাকা করে যদি ৫০০ মোবাইল বিক্রি করে দেওয়া হয় তাহলে এরই মধ্যে কোটি টাকার মোবাইল বিক্রি হয়েছে। এভাবে হয়তো আরও অনেক মোবাইল বাজারে বিক্রি করেছে মোজাম্মেল ও তাঁর সহযোগী জাহাঙ্গীর। তিনি নিজেও ইভ্যালিতে ৪ লাখের বেশি টাকার পণ্য অর্ডার করেছেন। সেই টাকার আশায় ঘুরছেন তিনি।

শুক্রবার রাতে ওই বাসায় মানুষের উপস্থিতি দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যান মোজাম্মেল। তখন তিনি গ্রাহকদের কাছ থেকে একদিন সময় চেয়ে নেন। পরদিন মোজাম্মেল ইভ্যালির এক গ্রাহককে জাহাঙ্গীর নামে একজনের মোবাইল নম্বর দিয়ে জানান ইনি তাঁর সিনিয়র কর্মকর্তা। মোজাম্মেল বলেন, জাহাঙ্গীরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে পণ্য পেয়ে যাবেন।

গ্রাহক আহাদ আহাম্মেদ ইভ্যালির জাহাঙ্গীরকে ফোন করলে তিনি নানা অজুহাতে সময় পার করেন। শনিবার সন্ধ্যার পরে ইভ্যালির সাভারের আমিনবাজারে সালেহপুর ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত ওয়্যারহাউসের গেটের বাইরে প্রতিষ্ঠানটির এইচআর বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন। পরে সেখানে মোস্তাফিজুর ওই গ্রাহকের কাছ থেকে আরও একদিন সময় চান।

১৯ সেপ্টেম্বর গ্রাহকেরা আবার মোজাম্মেলের বাসায় এলেও মোজাম্মেলকে পাওয়া যায়নি। তবে কিছুক্ষণ পরে হাজির হন জাহাঙ্গীর। দুদিন ধরে বড় কর্মকর্তা সেজে কথা বলা জাহাঙ্গীর স্বীকার করেন যে, তিনি ইভ্যালি সংশ্লিষ্ট কেউ নন। মোজাম্মেল তাঁর বোনের জামাই। তবে আগের দিন গ্রাহকদের মাল ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কথা বলার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোজাম্মেল তাঁর বোন জামাই। বোন জামাইকে বিপদ থেকে বাঁচাতে তিনি গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলেছেন। আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি পালিয়ে যান।

জাহাঙ্গীর সাভারের হেমায়েতপুরের শামপুর এলাকার বাসিন্দা। তাঁর ফেসবুক আইডিতে দেখা যায় ইভ্যালি নিয়ে নিয়মিত পোস্ট করেন তিনি এবং তাঁর প্রোফাইল ছবিতেও ইভ্যালির অন্য কর্মীদের মত ইভ্যালি ফ্রেম দেওয়া ছিল।

সিনিয়র কর্মকর্তা সেজে গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলতেন মোজাম্মেলের স্ত্রীর ভাই জাহাঙ্গীরসিনিয়র কর্মকর্তা সেজে গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলতেন মোজাম্মেলের স্ত্রীর ভাই জাহাঙ্গীর। ছবি: সংগৃহীত ইভ্যালির গ্রাহক আহাদ আহাম্মেদ জানান, গত শনিবারে জানতে পারি কয়েকজন কর্মকর্তা ইভ্যালির সাভারের ওয়্যারহাউস থেকে প্রচুর পরিমাণ মালামাল সরিয়ে বাসায় নিয়ে রেখেছে। পরে মোজাম্মেল নামের এক কর্মচারীর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দেখি তাঁর এক রুমে অনেকগুলো কার্টন রয়েছে। আরেক রুমের এক পাশে প্রায় অর্ধশতাধিক কার্টন। পরে আমরা কয়েকজন জোরপূর্বক দুটি কার্টন খুলে দেখি মোবাইল ফোন। একটিতে রিয়েলমি অন্যটিতে আইফোন এবং বাকি সব কার্টনেই মোবাইল ফোন আছে বলে জানায় মোজাম্মেল।

আহাদ আহাম্মেদ আরও বলেন, তখন আমার সঙ্গে আরও ১০ থেকে ১৫ জন গ্রাহক ছিল। আমরা আমাদের পণ্য চাইলে মোজাম্মেল আমাদের বলে যে, আগামীকাল পর্যন্ত সময় দেন আমার সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আপনাদের ব্যবস্থা করব। এর পরদিন বিকেল থেকে মোজাম্মেলের মোবাইল বন্ধ রয়েছে। পরে রোববার আবার মোজাম্মেলের শ্বশুর বাড়িতে এসে দেখি সে এবং তাঁর শ্বশুর এজাজ বাসায় নেই এবং ঘর ভর্তি সেই মোবাইল ফোনের কার্টনও নেই।

এই বাসায় পণ্যগুলো কি ইভ্যালির অফিশিয়াল সিদ্ধান্তেই এসেছিল নাকি মোজাম্মেল, জাহাঙ্গীর ও মোস্তাফিজুর রহমান মালগুলো পরিকল্পিতভাবে চুরি করে এনে বিক্রি করেছেন এ বিষয়ে ইভ্যালির সংশ্লিষ্ট কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

রোববার রাতে মোজাম্মেলের বাসা থেকে বেড়িয়ে এইচআর সহকারী ব্যবস্থাপক মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি বারবার কল কেটে দেন।

প্রসঙ্গত, গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় দায়ের করা মামলায় গত বৃহস্পতিবার ইভ্যালির সিইও মো. রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। এরই মধ্যে সেলারদের রেগুলার বিল দিতে না পারায় ‘ইভ্যালি টি-টেন’ অফারের অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

 

আপনি আরও পড়তে পারেন