এবার কাজে ফেরার লড়াই

ছুটি শেষ! নাড়ির টানে বাড়ি যাওয়া মানুষ ফের কর্মস্থলে ফিরছেন। ফেরিঘাট কিংবা মহাসড়কগুলোতে ফেরার লড়াই ছিলো চোখেপড়ার মতো। ফেরিঘাটগুলোতে হাজার হাজার মানুষের স্রোত! তীরে ফেরা ফেরিগুলোতে যেনো তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ঠাসাঠাসি করে যে যেভাবে পারছেন ফেরিতে উঠছেন। দিচ্ছেন তিন থেকে চারগুণেরও বেশি ভাড়া। অন্যদিকে মহাসড়কগুলোতে কেউ মোটরসাইকেলে করে, কেউ সিটি-জেলাকেন্দ্রিক গণপরিবহনে ভেঙে ভেঙে, কেউবা প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ভাড়া করে আবার কেউ মিনি পিকআপে করে ঢাকামুখী হচ্ছেন। গতকাল ফেরিতে পদ্মা পার হয়ে ঢাকাসহ আশপাশের জেলায় ফিরতে শুরু করে দক্ষিণ জনপদের কর্মজীবী মানুষ। সকাল থেকেই মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাট হয়ে হাজার হাজার মানুষ মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে আসতে শুরু করে। লকডাউনের কারণে দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় গন্তব্যে ফিরতে হিমশিম খেতে হয় তাদের।

বিআইডব্লিউটিসির এজিএম শফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জরুরি পরিষেবার যানবাহন পারাপারের জন্য ফেরি সচল রাখা হয়েছে। কিন্তু জরুরি যানবাহনের সঙ্গে কর্মস্থলে ফেরা মানুষও ফেরিতে উঠে পড়ছে এবং গাদাগাদি করে নদী পার হচ্ছে। এতে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বেড়ে যাচ্ছে। শিমুলিয়ায় ঢাকার দিক থেকে আসা যাত্রী ও যানবাহনের তেমন চাপ না থাকলেও মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটে ঢাকামুখী মানুষের প্রচণ্ড চাপ রয়েছে বলে জানালেন শফিকুল। বাগেরহাট থে?কে আসা আবিদ হোসেন নামে এক যাত্রী ব?ললেন, ‘নিজের জেলা থেকে তিনি ৬০০ টাকা ভাড়া দিয়ে আরও কয়েকজনের সঙ্গে মাইক্রোবাসে করে বাংলাবাজার ঘা?টে পৌঁছেছেন। অন্য সময় এই ভাড়া থাকে ৩০০ টাকা। আর বরিশাল শহর থে?কে আসা ফা?তেমা রহমান ব?লেন, ‘আমার বাংলাবাজার ঘা?ট পর্যন্ত আসতেই ৮০০ টাকা খরচ হ?য়ে গেছে। না এসে উপায়ও নেই, অফিস খু?লে গে?ছে।’ কাঁঠালবাড়িতে বিআইডব্লিউটিসির সহকারী ম্যা?নেজার ভজন কুমার সাহা জানান, এই নৌরুটে এখন চলাচল করছে ১৫টি ফেরি। ‘আজ (গতকাল) ভোর থেকে যাত্রীর চাপ বাড়তে শুরু করেছে। ফেরিতে করেই তারা পার হচ্ছে। আমরা পণ্যবাহী ট্রাক ও অ্যাম্বুলেন্সকে অগ্রাধিকার দেয়ার চেষ্টা করছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘাটের পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করছেন।’ করোনা মহামারির কারণে দেশে চলছে লকডাউনের বিধিনিষেধ; লঞ্চ, ট্রেন ও দূরপাল্লার বাসও বন্ধ রাখা হয়েছে। ঈদযাত্রার সঙ্গে ভাইরাস যেনো আরো ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য ছুটিতে সবাইকে কর্মস্থল এলাকায় থাকতে বলেছিল সরকার। কিন্তু ঈদের কয়েক দিন আগে থেকেই লাখো মানুষ যে যেভাবে পারেন সেভাবে গ্রামের বাড়ি গেছেন।

ঘরমুখো মানুষ ছোট ছোট যানবাহনে গাদাগাদি করে সে সময় বাড়িতে গেছে। ফেরিতেও ছিলো উপচেপড়া ভিড়। স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই ছিলো না কোথাও। ভিড়ের চাপে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ফেরিতে প্রাণহানিও ঘটেছে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে এভাবে ভ্রমণ, বিভিন্ন বিপণিবিতানে মানুষের ভিড়ের কারণে নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। ঝুঁকি নিয়ে সেই ঈদযাত্রা ঠেকানো না গেলেও এখন মানুষের ফিরতি যাত্রা বিলম্বিত করা যায় কীভাবে, সেই পথ খোঁজার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম। তিনি বলেছিলেন, ‘এই লকডাউনের মধ্যে আবার যদি লোকজন এভাবেই ফেরে তাহলে এটা অবশ্যই বিপজ্জনক হবে। এ কারণে এই ফেরাটা যদি একটু বিলম্বিত করা যায় ভালো হয়। এ ছাড়া যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে তাদের ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করা যায় সেটাও বিবেচনা করা যেতে পারে। সেই বিপদ এড়াতে সরকার ইতোমধ্যে লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রোববারই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির কথা রয়েছে।   

এদিকে সকাল থেকে রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর, সায়েদাবাদ, গাবতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে । সকাল থেকে ঢাকামুখী মানুষের স্বাভাবিক ভিড়। আন্তঃজেলা গণপরিবহনের চলাচল বন্ধ থাকার কারণে অনেকেই মোটরসাইকেলে চড়ে বাড়ি গিয়েছিলেন। অনেককে দেখা গেছে প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসে করে ফিরতে। এদিকে ফাঁকা ময়মনসিংহ সড়ক দিয়ে আসা ফিরতি মানুষদের টঙ্গী থেকে হেটে আব্দুল্লাহপুর আসতে দেখা গেছে। তারা আব্দুল্লাহপুর থেকে আবার অন্য যানবাহনে করে বাসায় ফিরছেন। চট্টগ্রাম ফেনী থেকেও মানুষ একই চিত্র দেখা গেছে। মোটরসাইকেল চালক ইশতিয়াক বলেন, ‘বাস চলে না তাতে কি! নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলাম। এখন রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা, চালাতেও ভালো লেগেছে। তাই মোটরসাইকেলে করে ঢাকায় ফিরলাম। আগামীকাল থেকে অফিস শুরু করবো।’ তবে ইশতিয়াকের মতো অনেকেই এবার ঈদের ছুটিতে মোটরসাইকেলে করে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলেন। যারা মোটরসাইকেলে করেই আবার ঢাকামুখী হচ্ছেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আলী আজম। ঈদের চারদিন ছুটি পেয়ে তিনি গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ভালুকায় গিয়েছিলেন। ঈদের ছুটি শেষে তিনি রোববার সকালে ঢাকায় ফিরলেন। তিনি বলেন, ‘ভালুকা থেকে মিনি পিকআপ ও টেম্পো করে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত এসেছি। সেখান থেকে একটি বাসে চড়ে টঙ্গী স্টেশনরোড পর্যন্ত এরপর হেঁটে আব্দুল্লাপুর পর্যন্ত এসেছি। এখন একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপর বাড্ডায় বাসায় যাবো। আগামীকাল থেকে আবার প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করবো।’ তিনি বলেন, ‘করোনা ঠেকাতে আন্তঃজেলা গণপরিবহন বন্ধ করেছে। কিন্তু মানুষজন ঠিকই বাড়ি গেছে। কষ্ট করেই গেছে। এখন আমাদের ঢাকায় ফিরতেও কষ্ট হচ্ছে। কাউকেই আটকাতে পারেনি। যদি গণপরিবহন খোলা থাকতো তবে এত কষ্ট হতো না। আর বন্ধ রেখেও কোনো লাভ হয়নি।’ একটি গণমাধ্যমে কাজ করেন হোসাইন আহমেদ মাসুম। তিনি বলেন, ‘আজ থেকে অফিস শুরু হয়ে গেছে। তাই চট্টগ্রাম থেকে প্রথমে ফেনী সেখানে কিছু সময় বিরতি দিয়ে ফেনীর মহিপাল থেকে মাইক্রোবাসে করে রাজধানীর সাইনবোর্ড আসি। চট্টগ্রাম থেকে ফেনী ৫০০ টাকা, সেখান থেকে ঢাকায় আসতে দিতে হয়েছে ৯০০ টাকা। এরপর ২০০ টাকা সিএজি ভাড়া দিয়ে মতিঝিল আসি।’

এ ছাড়া ঈদ শেষে রাজধানী ঢাকার দিকে ফিরতে শুরু করেছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। ফলে ভিড় বাড়ছে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে। রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট থেকে ফেরিতে করে পাটুরিয়া ঘাটে নেমে বিপাকে পড়ছেন অনেকে। দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় বাড়তি ভাড়া দিয়ে ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে যাচ্ছেন তারা। এদিকে ঈদের পরও ঢাকার দিক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলমুখী মানুষের ভিড় রয়েছে। দৌলতদিয়া থেকে পাটুরিয়া প্রান্তে আসা প্রতিটি ফেরিই যাত্রীতে ঠাসা থাকছে। মানুষের চাপে ফেরিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মতো অবস্থা নেই। পাটুরিয়া থেকে কিছু লোকাল বাস ঢাকার ধামরাইয়ের বারবাড়িয়া পর্যন্ত চলাচল করছে। এর বাইরে ভরসা ভাড়ায় চালিত প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা। সব ধরনের যানবাহনেই স্বাভাবিকের চেয়ে চার-পাঁচগুণ বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের।

গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পাটুরিয়ার ২ নম্বর ঘাটে এসে নোঙর করে ফেরি শাপলা-শালুক। ফেরিটিতে দুই-তিনটি ব্যক্তিগত গাড়ির সঙ্গে ছিলেন পাঁচ শতাধিক মানুষ। ঘাটে নেমে তারা কিছুটা পথ হেঁটে চলেন। এরপর বাস, প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলের বন্দোবস্ত করে ছোটেন ঢাকার দিকে। যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাটুরিয়া থেকে ঢাকার গাবতলী পর্যন্ত বাসে ভেঙে ভেঙে যেতে প্রত্যেককে কমবেশি ৪০০ টাকা করে গুনতে হচ্ছে। আর প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসে গেলে পরিমানটা বেড়ে হচ্ছে ৫০০ টাকার মতো। মোটরসাইকেলে গেলে লাগছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। এত বেশি ভাড়া গুনতে হওয়ায় নিম্নআয়ের মানুষেরা চরম বিপাকে পড়ছেন।

বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি) সূত্রে জানা গেছে, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ১৭টি ফেরি ছিলো। বর্তমানে এই নৌপথে ১৬টি ফেরি যাত্রী ও যানবাহন পারাপারে নিয়োজিত রয়েছে। যাত্রীদের চাপের ওপর নির্ভর করে প্রয়োজন-সংখ্যক ফেরি কাজে লাগানো হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ঈদ শেষে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার কর্মস্থলগামী যাত্রীরা দৌলতদিয়া থেকে ফেরিতে পাটুরিয়া আসছেন। আবার পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া প্রান্তে যাত্রীরা যাচ্ছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় নৌপথে প্রয়োজনীয়-সংখ্যক ফেরি চলাচল করছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন