কারো পৌষ মাস…

কারো পৌষ মাস...


প্রথম শীতের মাসে

শিশির লাগিল ঘাসে,

হুহু করে হাওয়া আসে,

হিহি করে কাঁপে গাত্র।

―রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; চিত্রা, শীতে ও বসন্তে

বাঙালির এই এক অভ্যাস। কিছু খেতে চাও। পরতে চাও। জানতে চাও। বুঝতে চাও। পড়তে চাও। লিখতে চাও। তো আগে একটু রবীন্দ্রনাথ হয়ে এসো। তো শীতের বেলায় তা আবার বাদ যাবে কেন। শীত নিয়েও বাংলার সব কথাই বলে গিয়েছেন রবি ঠাকুর। নতুন করে কী আর বলার সুযোগ আছে! পৌষ হয়ে শীত ঋতু আসে বঙ্গমুলুকে। ঘাসে ঘাসে শিশিরবিন্দুর নাচন। হুহু করে উত্তুরে হাওয়া বয়ে যায়। এখনো সেই হিহি করেই গা কাঁপে। আর এই কাঁপুনি ঠেকাতে শীতের বেলায় সবার আগে চাই গরমের পোশাক। তার মানে গরমকালের পাতলা পাতলা পোশাক-আশাক নয়। দেহখানি উষ্ণতায় ভরিয়ে দিতে পারে এমন পোশাক। আর রাতের বেলায় চাই লেপ-কম্বল।
কারো পৌষ মাস...তাই তো শহরে শীতের আগমনী ধ্বনি হচ্ছে গিয়ে- ‘এ্যাই, বানাই লেপ-তোশক!’ রাতারাতি বৈদ্যুতিক পাখার কিছু কিছু দোকান বনে যাচ্ছে কম্বলের দোকানে। মিলিয়ে নিন রাজধানী ঢাকার মালিবাগ রেল ফটকের আশপাশের বিপণিতে বিপণিতে।  রামে কম্বলের কারবার কম। লেপ রোদে দেয়া কিংবা বানানোর হিড়িক লেগে যায়। না থাকলে পুরনো শাড়ির পর শাড়ির পরত দিয়ে বানিয়ে নাও মোটা মোটা কাঁথা। হিমের কম্পন থামাতে রাতে গায়ে জড়াও দরকারমতো এক-দুই-তিনখানি। আগের চেয়ে কমলেও নানি-দাদিদের হাতে দেখা মেলে ওল আর আঙুলের খেলা। বুননে বুননে হয়ে উঠে সোয়েটার। আজকাল অবশ্য বানাবার বালাই কম। তৈরি পোশাকের বাহারি প্রদর্শনকেন্দ্র সবাইকে বেশি টানে। গরমের পোশাকের ব্যবসায়ীদের এই সময়টা তাই পৌষ মাস; তা অন্য যার যা যাক, যা সর্বনাশই হোক না কেন। শাল-সোয়েটার-জ্যাকেট, হুডি, টুপি, মোজা, জুতা; শীত তাড়াতে আর কী চাই। সবটাই মেলে ফুটপাতে কিংবা অভিজাত বিপণিবিতানে। পোশাক-আশাকের বেলায় শীতের বাজার তাই দারুণ গরম। পৌষের বাজার যেন হয়ে উঠে ফুলের বাজার। আসলে সবজিই থাকে। ফুল নয়। তবে দেখতে ফুলের মেলাই যেন। ফুলকপি, পেঁয়াজ পাতা, ধবধবে কিংবা লাল মূলা, বাঁধাকপিÑ এগুলো দেখতে ফুলের চেয়ে কম কী। শীতকে যারা রুক্ষ বলে পাতা ঝরার দিন বলে, সবজির ক্ষেত তাদের ভুল ভেঙে দিতে পারে নিমিষেই। তাতে এক কাঠি সরেস হতে পারে সরষের মাঠ। সবুজের মাঝে বিস্তীর্ণ হলুদ মাঠ। মাঠের পর মাঠ। নির্মাতার মনে নিশ্চয়ই চলে আসে চলচ্চিত্রের গানের কোনো দৃশ্যায়ন। যাতে নায়ক-নায়িকার ঘনিষ্ঠতা গানে গানে ঠোঁটে ঠোঁটে। আর নাইবা এগোই। এখানেই থামি।

এবার আমাদের যেতে হবে খেজুরের গাছে। রসের খোঁজে। গুড়ের খোঁজে। ধুলি উঠা পথ। আজকাল আবার মাটির পাওয়া কঠিন। প্রায় সবই পিচঢালা পথ। তবু দুই ধারে থেকে থেকে খেজুরের গাছ। পাঁচ কী ছÑসকাল থেকেই গাছে সওয়ার গাছি। তারপর দিনভর বেচাবিক্রির পালা। দুপুরের পর থেকেই আবার ছেনি নিয়ে ছুটে চলা। গাছের কাÐ চেঁছে চেঁছে বাঁশের কাঠির মুখে রসের হাঁড়ি ঝুলিয়ে দেয়া। রাতভর জমতে থাকবে রস। শীতের সকালে হিম হিম রস পান এক রোমাঞ্চ। হরর ছবির ভয়ের ভেতরেও যেমন ভালোলাগা জুড়ে থাকে। তেমনি কাঁপতে কাঁপতে রস পান। নিতান্তই যাদের অনীহা তারা জ্বাল দেয়া রসে নয়তো রসের পিঠায় মন মজান। খেজুড়ের গুড় তো পিঠার জন্য দেশজোড়াই বিখ্যাত। যার জন্য আবার আলাদা খাতির পেয়েছে ফরিদপুর, যশোর কিংবা ঢাকার কাছের মানিকগঞ্জ।

শীতে রোমাঞ্চ আছে। শীত উপভোগ্য বটে। এসবই সামর্থ্যবানের বেলায় সত্য। ধনবানের বেলায় বলা চলে। হতদরিদ্র, ভ্রাম্যমাণ মানুষ আর রনবী’র টোকাইদের জন্য নিদারুণ কষ্টের। তাদের ভাবনাজুড়ে শীত শীতই। তাই বুঝি বিক্রমপুরের লোকপ্রবাদ, ‘পৌষের শীতের মউষের গায়, মাঘের শীত বাঘের গায়।’ এখানে মউষ মানে মহিষ। গরিবের কাছে শীত মানে শীতই, ঠাÐা, হিম ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়েই তাদের জীবনের অভিধান। প্রেম, প্রকৃতি, উষ্ণতা, রুক্ষতার মতো কাব্যময়তা তাদের মাঝে নেই। তারা বুঝেন লাকড়ি, খড়ি, মরা পাতা, খড় জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দল বেঁধে গা গরম করার বিষয়-আশয়। উদার প্রকৃতি থাকায় গ্রামে শীত বেশি। শহরে কম। তবে দীনহীনের বেলায় কী গ্রাম, কী শহরÑ সবখানেই শীত আর শীত। রাজধানী ঢাকায়ও তাই প্রায়ই চোখে পড়ছে মানুষঘেরা আগুনের হলকা। ইন্টারনেটের যুগে এই সব দৃশ্য আজকাল ঘরে বসেই দেখা যাচ্ছে। ফেসবুকে টুইটারে। তবে একটা ছবি এবার বেশি মিলছে। নিশ্চয় ভাইরাল হয়েছে। সেই ছোট্ট এক শিশু। বিরান এক স্থান। একটি পাত্রে বসে মাথায় পানি ঢালছে। পাত্রের নিচে উনুন। আগুন জ্বলছে। গরম পানি গায়ে ঢালা আর কী! একটু উত্তপ্ত পরিবেশে গোসল সারা। তবে ছবিটি বানানো হতে পারে। সত্যি হলেও আমাদের দেশের যে নয়, সেই বিষয়ে আমার সন্দেহ খুব কম। হতে পারে ভারতবর্ষের কোনো প্রান্তের।

শীতে গোসল অবশ্যই বড় এক বালাই। কাঁপতে কাঁপতে পুকুর-নদী-খালে ঝাঁপিয়ে পড়া একটু সহজ বটে। কিন্তু সে তো গ্রামের বিষয়। শহরে গোসলঘরে কল বলুন আর ঝরনা বলুন, পানি বরফের চেয়েও বেশি ঠাÐা মনে হয়। তার জন্য পানি গরম করে নেয়া উত্তম। ঠাÐা-গরম মিলিয়ে নিলে ঠাÐা থেকে বাঁচা সহজ। পানি পাত্রে সিদ্ধ করে নিতে হবে। আর গিজার থাকলে তো কোনো কথাই নেই। যান্ত্রিক উপায়ে পানি গরম করা আর কী। তখন টেপ খুলে বালতি ভরে নিলেই হলো। তবে আজকালকার চিকিৎসকগণ গোসলের পানি হিসেবে বড় জোর কুসুম গরম মেনে নিতে পারেন। তার চেয়ে বেশি হলে চুলের ক্ষতি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ত্বকও।

শরৎ পেরিয়ে হেমন্ত যখন চলে আসে তখন থেকেই কিন্তু চোখে ভাসতে থাকে শীতের প্রসাধনের বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। ছোটপর্দায় হিম-ক্রিম, পেট্রোলিয়াম জেলি আর লিপজেলের হরেক প্রচারণা। গণমাধ্যম, রূপ-বিশেষজ্ঞ, চর্ম-বিশারদ থেকে থেকেই বলতে থাকেন, ‘ত্বকের যত্ন নিন, ত্বকের যত্ন নিন।’ গরমকালে ত্বকের অস্তিত্বই কী আমরা ভুলে যাই! এতো গেল দেহের বহিরাবরণের কথা। ভেতরের অবস্থাও আমলে নেয় শীত ঋতু। ঠাণ্ডা, সর্দি, গর্মি লেগেই থাকে। তাই ঘরে ঘরে কদর বাড়ে মধুর। ওষুধ-ডাক্তারের কাছে ঘন ঘন যাওয়া। বিশেষত শিশুদের শাসকষ্ট, নিউমোনিয়ার ঝুঁকি অনেকখানি বাড়ে এই সময়ে। তাই আলাদা সতর্ক হতে হয়, ছোট্টমণিদের কাছে যাতে কনকনে ঠাণ্ডা ঘেঁষতেই না পারে। কিন্তু তারা কী আর বারণ শোনে! গ্রীষ্মে যেমন মোটা কাপড় পরার বায়না ধরে, আর শীতে আবদার কেবল পাতলা কিছু পরার। এই ক্ষেত্রে কিন্তু শিশুদের জন্য ‘হ্যাঁ’ বললে চলবে না। যেভাবেই হোক শিশুটির দেহের ভেতর ঠাণ্ডা কোনোভাবেই যেন জেঁকে বসতে না পারে।

এতো শীত, তবু ঘরে বসে থাকায় সময় নয় এটা। চাষবাস, ব্যবসাপাতির ভরা মৌসুম এখন। চারদিক কর্মমুখর। সেটা দিনভর। শহরেও রাতারাতি রাত নেমে আসে। গরমে যেখানে দশটা-এগারোটা। শীতে সাতটা-আটটা বাজতেই রাস্তা থেকে মানুষ কমতে শুরু করে। আর গ্রামে তো সেই সূর্য পাটে নামতেই জনশূন্য পথ-প্রান্তর। একটা গানেই যেন সেই চিত্র কল্পময়, ‘শীতকালের রাতগুলো কাটতে যে চায় না…।’ কার যেন গানটা ঠিক মাথায় আসছে না এখন। সুমন-অঞ্জন-নচি, তাদের কারোরই হবে হয়তো।

রাত কাটুক আর না কাটুক শীত টো-টো করে হাঁটার আদর্শ সময় নিয়ে হাজির হয়। কেননা শরীরে এতটুকু ঘাম নেই। ক্লান্তি নেই। শক্তিক্ষয় নেই। তাই অফুরন্ত হাঁটতে পারা যায়। পাড়া বেড়ানো যায়। আপনি পর্যটক নন, তবু একটু বেরিয়ে আসেন নিশ্চয়ই। বাচ্চাদের ইশকুল বন্ধ। এমন সুযোগ কী আর মিলবে। শিশুরা এ সময়টায় মামা বাড়ি না গেলে যাবে আর কখন। তাই রাজধানী ঢাকার অনেক বাসাবাড়ি আজকাল তালাবন্দি। কার্যকারণ হিসেবে হাজির সেই বেড়াতে যাওয়া। মামাবাড়ি নয়তো দাদাবাড়ি মানে গ্রামের বাড়ি আর কী। পর্যটকরাও ব্যস্ত ভীষণ। ব্যস্ত হোটেল-মোটেল-কটেজ মালিকরা। দেশি-বিদেশি ভ্রমণপিয়াসীতে মুখর কক্সবাজার, কুয়াকাটা, কাপ্তাই, বান্দরবান। বাংলার সব দর্শনীয় স্থানেই এখন ভিড়। যাদের হাতে সময় কম, তারা দুই পা ফেলে ঘর হতেই দেখে নিন না শিশিরের বিন্দু। ঘাসের মাঠ তো খুঁজে পেতে আর সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

ঢাকাবাসী যারা তারা মুঘল যুগের জাহাঙ্গীরনগরে আছেন বটেন, তারা ঘুরে আসুন না একটু সবুজাভ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। খোলা হাওয়ায় দম নেয়ার দারুণ জায়গা সেটা। আর সেখানে এখন হৃদে হৃদে লাল-সাদা শাপলার সারি। আর তারই বাতাসে উড়াউড়ি করছে অতিথি পাখির দল। এই পাখিই কী আজকাল চিনিয়ে দেয় এই দেশ। যার কারণে তাদের আসার কিছুকাল পরে শীতের দেশ থেকে চলে আসে শীতের বুড়ি। আসে উত্তুরে হাওয়া। আচ্ছা, শীত থেকে বাঁচতে নাকি শীতের দেশ থেকে আসে অতিথি পাখি। তবে কী এই দেশে তাদের শীত লাগে না?

এই শীতে যে তাদের শীত লাগে না, তার প্রমাণ আমাদের শীতের পোশাকই। আমরা যে জ্যাকেট পরি সচরাচর; তা নিয়ে জনৈক ইউরোপবাসী বাঙালি আমাকে বলেছিলেন, এগুলো নাকি শীতের দেশের সামার জ্যাকেট। তার মানে তাদের গ্রীষ্মে যে হিম, আমাদের শীতে সেই ঠাণ্ডা। তাহলে আমরা শীতের দেশের মানুষ নই। আসলেই তো, ভূগোলের সিলেবাসে আমরা যে নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশের! শেষটা ভূগোলে নয়। টানতে চাই রবীন্দ্রনাথেই।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment