কালের বিবর্তনে বিলিন গরুর গাড়ি।

কালের বিবর্তনে বিলিন গরুর গাড়ি।
মাহফুজ হাসান,কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি:
“আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে
ধুত্তুর ধুত্তুর ধুত্তুর ধু সানাই বাজিয়ে
যাবো তোমায় শ্বশুর বাড়ি নিয়ে”
জনপ্রিয় বাংলা সিনেমা “আখি মিলন” সিনেমার জনপ্রিয় একটি গান।দুই যুগ আগেও গ্রামাঞ্চলে গরুর গাড়ি ছাড়া বিয়ে কল্পনা করা যেত না। বরপক্ষের লোকজন ১০ থেকে ১২টি গরুর গাড়ি সাজিয়ে বরযাত্রী যেত। সে সময় যেসব পরিবারে গরুর গাড়ি ছিল, তাদের কদর ছিল বেশি।
কিশোরগঞ্জের সদরের কর্ষা-কড়িয়াল ইউনিয়নের দামপাড়া গ্রামের আশি উর্ধ্ব  জৈনেক গাড়িয়াল মলিন কন্ঠে বলেন,
“একটা সময় এই পেশায় কামাই আচিন,সম্মান আচিন অহন নাই এল্লাইগা  আমরা ছাইরা দিচি।এ চারাও ইঞ্জিন টিঞ্জিন বাইর অয়া অহন আর গরুর গাড়ির চাহিদা নাই।
 গ্রাম বাংলার এক সময়ের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম গরুর গাড়ি। নতুন নতুন প্রযুক্তির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ঘটছে, হারিয়ে যাচ্ছে অতীতের এই ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি।
গরুর গাড়ি হলো দুই চাকাবিশিষ্ট যান বিশেষ, যা গরু বা বলদ টেনে নিয়ে যায়। একসময় কৃষি ফসল ও মানুষ বহনের জনপ্রিয় বাহন ছিল এই গরুর গাড়ি। মালপত্র পরিবহনে গরুর গাড়ি ছিল একমাত্র পরিবহন।
জানা যায়,গরুর গাড়ির ইতিহাস সুপ্রাচীন। নব্যপ্রস্তর যুগের সময় থেকেই মানুষ এই যানটি ব্যবহার করে আসছে। সিন্ধু অববাহিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গরুর গাড়ির প্রচলন শুরু হয় খ্রিস্টের জন্মের ১৬০০ থেকে ১৫০০ বছর আগে। সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে।
মাঝেমধ্যে প্রত্যন্ত এলাকায় দু-একটি গরুর গাড়ি চোঁখে পড়লেও শহরাঞ্চলে একেবারেই দেখা যায় না। সে কারণে শহরের ছেলে মেয়েরা দূরের কথা, বর্তমানে গ্রামের ছেলে মেয়েরাও গরুর গাড়ি শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়।
গরুর গাড়ির চালককে বলা হয় গাড়িয়াল। সেই চালককে উদ্দেশ্য করে রচিত হয়েছে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ কিংবা ‘আস্তে বোলাও গাড়ি, আরেক নজর দেখিয়া ন্যাং মুই দয়ার বাপের বাড়িরে গাড়িয়াল’ এরকম যুগান্তকারী সব ভাওয়াইয়া গান।
কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার রফিকুল ইসলাম জানান,বর্তমানে নানা ধরনের মোটরযানের কারণে অপেক্ষাকৃত ধীর গতির এই যানটির ব্যবহার অনেক কমে এসেছে। তাই এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। এখন মানুষ বিভিন্ন ধরণের প্রয়োজনীয় মালামাল বহনের জন্য ট্রাক, পাওয়ার টিলার, লরি,টমটম, নসিমন-করিমনসহ বিভিন্ন মালগাড়ি ব্যবহার করছে। মানুষের যাতায়াতের জন্য রয়েছে মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যান।ফলে গ্রামাঞ্চলেও আর চোখে পড়ে না গরুর গাড়ি।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের খাইরুল ইসলাম জানান,সেই ঐতিহাসিক গরুর গাড়ি এখন আর চোখে পড়েনা, হঠাৎ হঠাৎ মহিষের গাড়ি লক্ষ্য করা যায়,তবে টায়ারের চাকা।আগেকার গরুর গাড়ির চাকা ছিল কাঠের তৈরি, কটকট,মটমট শব্দে যেন প্রাণে শিহরণ জাগাতো।গরুর গাড়ি জ্বালানি বিহীন একটা বাহন আজ বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে।
 জেলা সদরের চিকনির চর গ্রামের মনিরুজ্জামান বলেন, গরুর গাড়ির একটি সুবিধা হলো, পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন। এতে কোনো জ্বালানি লাগে না। ফলে ধোঁয়া হয় না। আবার ধীরগতির কারণে এতে তেমন কোনো দুর্ঘটনারও আশঙ্কা থাকে না। যুগের পরিবর্তনে আমাদের প্রিয় এই গরুর গাড়ি প্রচলন আজ হারিয়ে যাচ্ছে কালের অতল গর্ভে।

আপনি আরও পড়তে পারেন