কিশোরগঞ্জে পালতোলা নৌকা বিলুপ্তিপ্রায়।

কিশোরগঞ্জে পালতোলা নৌকা বিলুপ্তিপ্রায়।
মাহফুজ হাসান,স্টাফ রিপোর্টার:
পুবালি বাতাসে
বাদাম দেইখা চাইয়া থাকি,
আমার নি কেউ আসে রে।।
আষাঢ় মাইসা ভাসা পানি রে।।
ঢালিউডের ” শ্রাবণ মেঘের দিন”ছায়াছবিতে
উকিল মুন্সির লেখা, কন্ঠ শিল্পী বারী সিদ্দিকীর
গাওয়া এ গানের অন্তরাটি মনে করিয়ে দেয় বিলুপ্ত হওয়া পালতোলা নৌকা বা নৌকায় উড়ানো বাদামের (পাল)কথা।
একসময় কিশোরগঞ্জের  নদীগুলোতে সারি সারি পালতোলা নৌকা চোখে পড়তো। এখন সময়ের বিবর্তন, জৌলুস হারানো নদ-নদীর করুণ অবস্থা আর যান্ত্রিক সভ্যতা বিকাশের ফলে বিলুপ্তির পথে আবহমান গ্রামবাংলার লোক-সংস্কৃতির অন্যতম ধারক পালতোলা নৌকা।
সাংবাদিক মাহফুজ রাজা ‘র ছন্দময় পঙক্তিতে  ফুটে উঠে বাস্তবতা
“নদীর পাড়ে বাড়ি আমার নদীর পাড়ে ঘর,
জানালার ফাঁকে যখন পড়ে জলেতে নজর,
 পালতোলা নৌকা চলে দৃশ্য মধুকর।
আসে সগন,মায়ার লগন,সুখে ভরে অন্তর।।
তিনি আরও বলেন, কিশোরগঞ্জ জেলার
 হোসেনপুরের ব্রম্মপুত্র নদ পাড়ে বাড়ি, ছেলেবেলা কেটেছে পূবালী বাতাসে পালতোলা নৌকা,মাঝিদের মুখে ভাটিয়ালি গান,দাঁড় বা গুণটানা নৌকার আবেগঘন দৃশ্য দেখে, সবই এখন অতীত।
জানা যায়- জেলার কোথাও কোথাও হাতে গোনা দু’একটা পালের নাও, বাদামি নাও চোখে পড়লেও নেই আগের মতো জৌলুস। এসব নৌকায় আগের মতো আর মানুষ ওঠে না। নববধূ শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য পালতোলা নৌকার বায়নাও আর ধরে না।
হাওর-বাওরের দেশ কিশোরগঞ্জের বেশিরভাগ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল নদী আর পালের নৌকা, ডিঙ্গি নৌকাসহ বিভিন্ন নৌকার। এই তো ১০ থেকে ১৫ বছর আগেও জেলার নদ-নদীগুলিতে ব্রহ্মপুত্র নদ, মেঘনা, ধনু, ঘোড়াউত্রা, বৌলাই, নরসুন্দা, মগরা, বারম্ননী, চিনাই, সিংগুয়া, সূতী, আড়িয়াল খাঁ, ফুলেশ্বরী, সোয়াইজানী, কালী, কুলা নদীর বুক চিড়ে বয়ে বেড়াতো সারি সারি নৌকা।
ব্রম্মপুত্র পাড়ের বাসিন্দা আব্দুল ওয়াদুদ বলেন,ছোটবেলায় দেখতাম আমাদের স্থানীয় নৌকাঘাট হাজীবাড়ী থেকে গলাকাটা পর্যন্ত তাছাড়া আমরা হোসেনপুর বাজারে যেতেও নৌকায় যাতায়াত করতাম,ভাটি জলে নৌকা বৈঠায় চালাতো মাঝিরা আর উজানে আসলে পালতোলতো এবং পিছন গলইয়ে বসে শুধু একজন মাঝি বৈঠা ধরে গুনগুনিয়ে মরমি গান করতো,ভালোই লাগতো তখন সময়টা। এসব নৌকায় ছিল রঙিন পাল। স্বচ্ছ পানির কলতান আর পালে লাগা বাতাসের পত পত শব্দ অন্যরকম অনুভূতি জুগিয়ে যেতো প্রাণ।
আরও জানা যায়- সারি সারি নৌকার ছন্দবদ্ধ চলা আর বাতাসে পাল উড়ার মনোরম দৃশ্য দেখে মনপ্রাণ আনন্দে নেচে উঠতো।মাঝনদী থেকে ভেসে আসা দরাজকণ্ঠে ভাটিয়ালি গানের সুর এখন আর শুনা যায়না।
ব্রম্মপুত্র নদের খেয়াঘাটের মাঝি সজল মিয়া বলেন,যান্ত্রিক সভ্যতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে পালতোলা নৌকা। কদর নেই মাঝি-মাল্লাদেরও। নৌকায় পাল এবং দাঁড়-বৈঠার পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজেলচালিত ইঞ্জিন।আমি আগে পালের নৌকা চালাইতাম,এখন আধুনিক যুগ সবকিছু সহজ হয়ছে, তাই ইঞ্জিনের নৌকা চালাই।
পালের নাওকে উপজীব্য করে যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা রচনা করেছেন কত শত গল্প, কবিতা, ছড়া, পালাগান। চিত্রকর এঁকেছেন নান্দনিক শিল্পকর্ম। শুধু দেশি কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী বা রসিকজনই নন বরং বিদেশিদের মনেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে পালের নাও।
জেলার বাজিতপুরের দিলালপুর ঘাটে,পাটুলী ঘাটে এসে দেখা যায়, আগে সারি সারি পাল তোলা নৌকা বাঁধা থাকতো। এখন সেই ঘাট দখল করে নিয়েছে শ্যালো ইঞ্জিলচালিত নৌকা।
জেলার হোসেনপুর উপজেলার একাধিক তরুণের সাথে কথা হয়, অনেকেই জানেই না নৌকার পালের ব্যবহার। কালের আবর্তে এক সময় পরবর্তী প্রজন্মের শিশুরা ভুলে যাবে, ‘পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও’ ইত্যাদি ছড়া। বিচিত্র রঙের পালের বাহারিতে ঝলমল করবে না, এ দেশের নদ-নদী, খাল-বিল।
কিশোরগঞ্জ জেলা একতা বাউল ও যন্ত্রসংগীত শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাউল কামাল সরকার বলেন, পালের নৌকা নিয়ে জ্ঞানী গুনী সাধুজনরা অসংখ্য গান রচনা করেছেন।বিভিন্ন গানে উপমা হিসেবে ব্যবহার হয়েছে বাদাম নৌকা কিম্বা পালের নৌকা কিম্বা পাল বা বাদাম।আগে নৌকাই ছিল আদি বাহন। যুগের চাহিদা অনুযায়ী ইঞ্জিন নৌকা বা ট্রলারেরও আবেদন রয়েছে। তাই বলে গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ভুলে গেলে চলবে না। সেই নৌকাগুলোর কদরও যাতে সবসময় থাকে তারও একটা ব্যবস্থা হওয়া প্রয়োজন।
স্থানীয় সিনিয়র সাংবাদিক সঞ্জিত চন্দ্র শীল বলেন,১০/১৫ বছর আগেও বিভিন্ন আকার ও ধরনের নৌকাই ছিল মানুষের যাতায়াত ও পরিবহনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। এসব নৌকা চালানোর জন্য পালের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। হাজারীপাল, বিড়ালীপাল, বাদুরপাল ইত্যাদি পালের ব্যবহার ছিল নৌকাগুলোতে। পালের নৌকার পাশাপাশি মাঝিদেরও বেশ কদর ছিল একসময়। প্রবীণ মাঝিরা নৌকা চালানোর বিভিন্ন কলাকৌশল সম্পর্কে বেশ পারদর্শী ছিলেন। তাদের হিসেব রাখতে হতো জোয়ার-ভাটার, বিভিন্ন তিথির এবং শুভ-অশুভ ক্ষণের।এখন এসব কথা শুধুই স্মৃতি।

আপনি আরও পড়তে পারেন