কেশরাজের রস ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে বিশেষ কার্যকরী।

কেশরাজের রস ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে বিশেষ কার্যকরী।
মাহফুজ রাজা,জেলা প্রতিনিধি, কিশোরগঞ্জ ;
” মাঠের ছোট ছোট ঘাস ফুল
হারিয়েছে কি কোন বধুর নাকফুল “
কেশরাজ ভেষজ গুণীয় উদ্ভিদ, গ্রাম বা শহর সর্বত্রই যার অবাধ বিচরণ। কেশরাজের বহু নাম রয়েছে কেউ বলে কালোকেশী,  কেশড়ে,   কালোকশী, কেশঠি,  কোশুতি, খেতুয়া,  মইরচর, ভৃঙ্গরাজ, কালসাতার, কালোকেশশিরিয়া,  কালাহুনা কেশার্ত, কেশরাজ, বাংড়া। এর আয়ুর্বেদিকক নাম – ভৃঙ্গরাজ।ইংরেজি নাম – False Daisy।বৈজ্ঞানিক নাম : Eclipta alba Hessk.
সব মানুষ তাকে চেনে তার গুণের জন্য। অবশ্য সেই গুণ এখন আর তেমন কাজে লাগায় না। কেশড়ের রস মাথায় দিলে চুলের গোড়া মজবুত হয়। কেশড়ে মেঠো উদ্ভিদ। পতিত জমিতে যেমন দেখা যায়। ফসল ক্ষেতও কেশড়ের ভীষণ পছন্দ। আর পছন্দ ক্ষেতের আল। আলের দূর্বাঘাসের জটলার ভেতর কেশড়ে গাছের দেখা মিলবেই।কেশড়ে গাছকে অনেকে ঘাস মনে করে। কিন্তু কেশড়ে তৃণশ্রেণীর গাছের মধ্যে পড়ে না। কেশড়ে বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ।
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের প্রায় সব এলাকায় সব মাঠে কেশড়ে গাছ দেখা যায়। গাছের গড় উচ্চতা ১ ফুট। কিছু কিছু গাছ তিন ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। সাধারণত কেশড়ে গাছের কিছুটা হেলেপড়া ভাব আছে। তবে যেগুলো খুব বড় হয় সেগুলোর অবশ্য হেলেপড়া ভাব থাকে না। কেশড়ের কাণ্ড ও ডাল রসালো। কাণ্ড নরম, গোল। বেড় আধা সেন্টিমিটার। কাণ্ডের গায়ে সাদা শুঙ্গ আছে। তাই কাণ্ড মসৃণ নয় খসখসে। কাণ্ডে খুব বেশি ডালপালা বের হয় না। তিন-চারটা ডাল বেরোয় মাত্র।কেশড়ের পাতা লম্বাটে। খসখসে। পাতার দৈর্ঘ্য ২ থেকে ২.৫ ইঞ্চি। প্রস্থ আধা ইঞ্চি। রঙ সবুজ, রসালো। পাতার কিনারগুলো আঁকাবাঁকা।
 সূর্যমুখীর মতো ফুলের কিনার গোল করে ছোট ছোট সাদা পাপড়ি দিয়ে সাজানো। পাপড়ি শুকিয়ে ঝরে গেলে ফুলটাই ফলে পরিণত হয়। ফুলের মাঝখানেই ছোট ছোট ত্রিকোণাকার বীজ দিয়ে সাজানো থাকে। কাঁচা ফল ও বীজ সবুজ রঙয়ের। পাকলে বীজের রঙ হয় কালো। অনেকটা কালোজিরার মতো দেখতে। বীজ দ্বি-বীজপত্রী। কেশড়ে বারোমাসী উদ্ভিদ। তাই বছরজুড়ে এদের দেখা যায়। উপজেলার প্রায় প্রতিটি স্থানে।
নদী-নালা, খাল-বিল, কিংবা পথের ধারে নরম ও আর্দ্র মাটিতে জন্মায়। গ্রীষ্মের শুরু থেকে পুরো বর্ষায় এ গাছে ফুল ফোটে।
দীর্ঘ কালো চুলের জন্য ভৃঙ্গরাজ তেল দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহার করে আসছেন চুলের পরিচর্যাকারী। চুলের যত্নেও মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই এই ভেষজটি ব্যবহার করে আসছে।এর পাতা, কান্ড, ফুল ও ফল সবই উপকারী।
বিশেষজ্ঞদের মতে,উদ্ভিদটি জাল দিয়ে নির্যাস তৈরী করে মায়োকার্ডিয়াল ডিপ্রেস্যান্ট ও হাইপোটেনসিভ এবং কয়েকটি পাতা বেটে খেলে কৃমি ও কাশি কম হয়।
পাতা, ফুল ও ফলসহ বেটে রস তৈরী করে নিয়মিত কিছুদিন মাথায় দিলে মাথা ঠাণ্ডা হবে, চুল পড়া বন্ধ হবে, চুল লম্বা ও কালো হবে। প্রতিদিন রস সংগ্রহ করা না গেলে এক কাপ রস তৈরী করে ২৫০ মিলিলিটার তিল তেল বা নারকেল তেল মিশিয়ে ব্যবহার করলেও উপকার পাওয়া যাবে।
 শরীরের কাটা যাওয়া স্থানে কেশরাজের পাতা বেটে পেস্ট বানিয়ে লাগালে সঙ্গে সঙ্গে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে কাটা স্থানের ক্ষত শুকিয়ে যায়। প্রদাহনাশক, ব্রঙ্কোডায়ালেটর, এন্টিসেপট্কি ও রক্তপড়া বন্ধে ব্যবহৃত হয়।
 ডাঃ পল হায়দার, ডাঃ আলমগীর মতি, হারবাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের সূত্র মতে, কেশরাজের কাঁচা পাতা বেটে রস তৈরী করে মাথায় ঘষে ঘষে লাগাতে হবে, এরপর কেশরাজের মিশ্রন চুলে শুকিয়ে আসলে, পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এছারা ২৫০ এম এল তিল/নারিকেল তেলের সাথে এক কাপ কেশরাজের কাঁচা রস, তার সাথে আমলকি১টি, জবাফুল১টি, কারিপাতা ৪-৫ টি, ১ চা চামচ মেথী দানা একসংগে মিশিয়ে ফুটিয়ে নিয়ে ঠান্ডা করে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ছেকে কাঁচের বোতলে সংগ্রহ করে রাখা যায়। তৈরীকৃত মিশ্রনটি মাথায় মালিশ করলে মাথা ঠাণ্ডা হবে, চুল পড়া বন্ধ হবে, চুল লম্বা ও কালো হবে।
উকুননাশক: কেশরাজের পাতার রস চুলের গোড়ায় লাগান। এরপর একটি পাতলা কাপড় মাথায় পেঁচিয়ে রাখুন। এক ঘণ্টা পর চুল শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে অন্তত দু বার এটা করুন। এক মাসের মধ্য চুল হবে উকুনমুক্ত।
 নিরাপদ কীটনাশক: জার্নাল প্যারাসিটোলজি রিসার্চের গবেষণায় দেখা গেছে যে কেশরাজ পরিবেশে কোনও প্রতিকূল প্রভাব ছাড়াই মশার লার্ভা প্রসারণ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। দু চা চামচ কেশরাজ এর কাঁচা রস ৫০০ এম এল পানির সাথে মিশিয়ে আপনার ঘরের ভিতর/বাহিরে স্প্রে করে মশার আক্রমন হতে রক্ষা পেতে পারেন।
 লিভার ও কিডনী ক্ষতিরোধ করে: লিভারের সুরক্ষায় কেশরাজে বিদ্যমান অ্যামিডোপাইরিন এন-ডিমথাইলিন গ্লুকোজ-৬ ফসফেটের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে লিভার এ্যাবসেস, লিভার সিরোসিস, লিভারের প্রদাহ, জন্ডিস দূর করতে সাহায্য করে। লিভার টনিক হিসেবে কাজ করে।
দৈনিক কেশরাজ পাতার রস ১ চা চামচ আধাকাপ পানির সাথে মিশিয়ে পাতা খেলে খেলে সেটা রক্তস্রোত থেকে সব ধরনের ক্ষতিকারক উপাদান বের করে দিয়ে শরীরকে ডিটক্সিফাই করে।
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র সুরক্ষা সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে কেশরাজের নির্যাস কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপ্ত করে।
 ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে:  এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ২ চা চামচ পরিমাণ কেশরাজের রস সেবন করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। কেশরাজের রস ব্লাড সুগার লেভেল ও গ্লাইকোসাইলেটেড হিমোগ্লোবিন এর পরিমাণ কমায় এবং গ্লুজোজ-৬ ফসফেট এবং ফ্রুকটোজ ১, ৬ ডাইফসফেট এর কার্যকারিতা কমায় ও লিভারের হেক্রোকিনেজ এর কার্যকারিতা বাড়ায়।
কৃমি: কেশরাজ পাতার রস নিয়মিত ১ চা চামচ আধাকাপ পানির সাথে মিশিয়ে খেলে কৃশি দূর হয়।
সতর্কীকরণ:১. কেশরাজ গর্ভের সন্তানের জন্য বিষাক্ত হতে পারে। সন্তান বুকের দুধ খাওয়ানোর বয়সে কেশরাজ এড়িতে চলা উচিত।
২. এলার্জির লক্ষন দেখা দিলে কেশরাজ খাওয়ানো যাবে না।
৩. আপনার রক্তচাপ ইতিমধ্যে খুব কম হলে, এটি গ্রহন না করাই ভাল।
৪. হার্ট বা কিডনি সমস্যার কারণে কেমোথেরাপির মাধ্যমে যাচ্ছে তারা কেশরাজ ব্যবহার করবেন না।
৬. যদি আপনার টাইপ ২ ডায়াবেটিস থাকে, তবে কেশরাজ এড়িতে চলা উচিত।দৈনিক এক চা চামচের বেশি ব্যবহার না করাই শ্রেয়। আর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, যে কোনো কিছু গ্রহণের আগে একবার চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
পথের ধারে পায়ে মাড়িয়ে চলা ছোট গাছটাও হতে পারে কারো, জীবন বাঁচানো মহাঔষধ,তাই গাছকে অবহেলা নয় ভালবাসুন, গাছের পরিচর্যা করোন।

আপনি আরও পড়তে পারেন