ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে হামলা, ধর্ম ও বর্ণবাদের সম্মিলিত রূপ

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদের হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সারা বিশ্বে যে ঘৃণার চাষ হচ্ছে তারই উৎপাদিত ফল এটা। আমাদের দেশের অনেককেই দেখলাম, তার মধ্যে কেউকেটাও অনেকে রয়েছেন। বলছেন, যারা এই নির্মম ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের জঙ্গি বা সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে না কেন? এ বিষয়ে বলার আগে, এমন নৃশংতার জন্য দায়ীদের ৭৪ পৃষ্ঠার বক্তব্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া প্রয়োজন, যা তারা প্রকাশ করেছে সামাজিকমাধ্যমে। যাকে এই খুনি গোষ্ঠী বলছে, ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’।

সেই বক্তব্যটি একটু খুঁটিয়ে দেখলেই, খুনি ব্রেন্টনদের ঘৃণাবাদী চিন্তার কতগুলো কারণ পরিষ্কার হয়ে যাবে। যার মধ্যে প্রধান দুটি হচ্ছে ধর্ম ও বর্ণবাদী চিন্তা। ইসলামের প্রতি ঘৃণা এই গোষ্ঠীটির শুধু সাম্প্রতিককালের আল কায়েদা বা আইএসের পাল্টা প্রতিক্রিয়া নয়। এই ঘৃণা শত বছরের। ব্রেন্টন বা তার গোষ্ঠী জানাচ্ছে, ‘ইউরোপিয়রা দাস ছিল মুসলিমদের। মুসলিমরা তাদের ‍ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন শত বছর ধরে। সেই ইউরোপিয়ানদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিচ্ছে ব্রেন্টন টারান্ট।’ এটা হলো ধর্মীয় দিকের কথা। এর বাইরে রয়েছে বর্ণবাদী আরেকটি বক্তব্য। ব্রেন্টন বা তাদের চিন্তা জানাচ্ছে, ‘বাদামীদের কোনোভাবেই ইউরোপের মাটিতে মেনে নেওয়া হবে না।’ শুধু ধর্ম নয়, এদের ভেতর কাজ করছে বর্ণবাদী উগ্রতাও। এরা পরিষ্কার জানাচ্ছে, ‘ইউরোপের ভূমি মুক্ত করতে হবে নন হোয়াইটদের কাছ থেকে।’ একেবারে হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের কথা এবং তার সাথে যোগ হয়েছে ধর্মীয় চিন্তার।

এই গোষ্ঠীর চিন্তার সঙ্গে যদি আল কায়েদা বা আইএসে’র চিন্তার তুলনায় করা যায়, তাহলে দেখা যাবে ধ্বংসের পরিধি এই গোষ্ঠীটির দ্বিগুন। আইএস বা আলকায়েদার কোনো বর্ণবাদী চিন্তা নেই। অনেক সাদা চামড়ার মানুষ আইএসে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করেছে, এ ক্ষেত্রে আইএসের চিন্তায় বর্ণ কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, তথাকথিত ধর্মীয় চিন্তাই ছিল প্রধান। কিন্তু ব্রেন্টন গোষ্ঠীর চিন্তাটা দ্বিগুণ ভয়াবহ। এরা ইসলামকে ইউরোপে ঠাঁই দিতে চায় না, সাথে সাদা বাদে অন্য চামড়ার কাউকেও নয়। অর্থাৎ এই গোষ্ঠীটি শুধু ধর্মীয়ভাবেই উগ্র নয়, উগ্র বর্ণবাদীও। আর ধ্বংসবাদী এমন দুটি চিন্তার সম্মিলন, সত্যিকার অর্থেই ভয়ানক। এমন চিন্তার মানুষের কাছে মুসলমান কেন, কোনো ধর্মের মানুষই নিরাপদ নয়। বাদামী বা কালো চামড়ার খ্রিস্টান হলেও নয়।

ব্রেন্টন গোষ্ঠী এটাকে সশস্ত্র সংগ্রাম বা যুদ্ধ হিসাবে ঘোষণা করেছে। তারা যে কোনো প্রক্রিয়ায় সাদা চামড়া ব্যতীত অন্যদের প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে এবং সেটা গণহত্যার মাধ্যমে হলেও। কী ভয়াবহ কথা। আইএসও সম্ভবত গণহত্যার কথা এমন পরিষ্কারভাবে বলেনি। ব্রেন্টন গোষ্ঠীর ক্ষোভ অভিবাসীদের প্রতি, এমন কথা যারা বলতে চান, তারা মূল সমস্যাটাকে পাশ কাটাতে চাচ্ছেন। ব্রেন্টন গোষ্ঠীর ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্টে’ এমন কথা থাকলেও এটা মূল কথা নয়। মূল কথা হলো, এক সময় ইউরোপে মুসলমানদের কর্তৃত্ব ছিল এটা তাদের ক্ষোভের বিষয় এবং হোয়াইট সুপ্রিমেসি তথা সাদা চামড়ার প্রভুত্ব তাদের দাবির বিষয়। আর অভিবাসীদের কারণে সাদা চামড়ার বর্তমান প্রাধান্য ক্ষুণ্ন হতে পারে এটা তাদের আশঙ্কার বিষয়। ধর্ম আর বর্ণ হলো তাদের ঘৃণার গাছের গোড়া আর অভিবাসী বিষয়টি হলো ডালপালা।

সুতরাং ব্রেন্টন গোষ্ঠীর মূল তথা গাছের গোড়া হলো ধর্ম ও বর্ণবাদ। দুটি ভয়ঙ্কর উগ্রপন্থার সংযোগ, সম্মিলিত রূপ। এই রূপের কাছে আল কায়েদা বা আইএস নস্যি। এই রূপকে ব্রেন্টন গোষ্ঠী লুকিয়েও রাখেনি। ব্রেন্টন নিজেকে দাবি করেছে রেসিস্ট ও ফ্যাসিস্ট হিসাবে। সত্যিকার উগ্রবাদীদের কোনো রাখঢাক থাকে না, তারা যা করবে পরিষ্কার জানায় এবং করার চেষ্টা করে। শুধু তাই নয়, এমন চিন্তার ধারকরা তাদের টার্গেটদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, তাদের নিয়ে পরিহাস করে। ব্রেন্টন গোষ্ঠীর বক্তব্যও তার প্রমাণ দেয়।

ব্রেন্টন ও তার চিন্তা বলছে, ‘তুমি যদি পরাজিত হও তবে ইতিহাস তোমাকে দানব বলবে, সেখানে পদ্ধতি কোনো ব্যাপার না। প্রথমে জয়ী হও, তারপর না হয় ইতিহাস রচিত হবে।’ নচিকেতার গানের কথা আবার উল্লেখ করতে হয়। ‘বিজয়ীরা বরাবর ভগবান এখানেতে, পরাজিতরাই পাপী এখানে’- রেসিস্ট এবং ফ্যাসিস্টরা এ কথাটাকেই তাদের মূলমন্ত্রভাবে। তারা যেকোনো মূল্যে জয়ী হতে চায়, চাণক্যের ‘সাম-দাম-ভেদ-দণ্ড’, যেকোনো উপায়ে। গুম-খুন-গণহত্যা রেসিস্ট বা ফ্যাসিস্টদের কাছে কোনো ব্যাপারই না। তারা ভাবে, ‘রাম যদি হেরে যেত রাবণ দেবতা হতো’ এবং ইতিহাসও যেত রাবণের পক্ষে।

ফুটনোট : পৃথিবীর তাবৎ আক্রান্তদের চিত্র এক, পরিবারের মর্মবেদনা এক। ধর্ম-বর্ণ, চিন্তা-দর্শনের বিভেদকে যারা ঘৃণায় রূপান্তরিত করে তাদের চেহারাও এক।

আক্রান্তদের পাশ দাঁড়ানো, সে যেই হোক মানুষের মানবিক দায়িত্ব। সমপরিমাণ দায়িত্ব ঘৃণাবাদীদের চিহ্নিত করা। ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে জানিয়ে দেওয়া, এরা ঘৃণার চাষ করে, আমরা করি মানবতার।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment