ক্রেতা নেই, আড়তে-ট্রলারে পচছে তরমুজ

‘ব্যবসা করি ২৫ বছরের ওপরে। এ বছরের মতো এত তরমুজ পচা দেখিনি। ট্রলার-গাড়ি ভাড়া করে চাষিরা তরমুজ নিয়ে আসেন। আসতে আসতে অর্ধেক পচে যায়। আর ক্ষেতেতো অর্ধেক পচেই গেছে। খালি হাতে বাড়ি ফিরছেন চাষিরা’

কথাগুলো বলছিলেন বরিশালের তরমুজ ব্যবসায়ী মনির হোসেন। মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) দুপুরে বরিশাল পোর্ট রোড খালের পাড়ে তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। শুধু মনির হোসেন নন, মূলধন হারানোর পথে অসংখ্য তরমুজ চাষির দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছে দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ তরমুজের এই বাজার।

বরিশাল পোর্ট রোডের আড়তদার মনির হোসেন জানান, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার ধুলিয়া নদীর তীরবর্তী গ্রামের চাষি চান মিয়া এবার ২২ লাখ টাকা খরচ করে তরমুজ চাষ করেছিলেন। বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যা ছিল তা নিয়ে এসেছিলেন এখানে। যা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা বিক্রি করতে পারতেন। ৩০ মার্চ রাতে বাড়ি ফিরে তরমুজ ক্ষেতেই বিষপান করেন চান মিয়া। তাকে উদ্ধার করে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে তিন দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩ এপ্রিল সকালে মারা যান।

মনির বলেন, চান মিয়া আমার কাছ থেকেও দুই লাখ টাকা দাদন নিয়েছিলেন। এভাবে আরও অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তরমুজ চাষ করেছিলেন। যখন দেখলেন লাভতো দূরের কথা মূলধনও উঠবে না তখন হয়তো আক্ষেপে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।

ভোলার চাষি ফয়সাল বলেন, তিন লাখ টাকা ব্যয় করে তরমুজ চাষ করেছিলাম। বৃষ্টির আগে এক লাখ টাকা বিক্রি করতে পেরেছি। সেখান থেকে ২০ হাজার টাকা পরিবহন ও শ্রমিক খরচ দিয়ে ৮০ হাজার টাকা টিকেছে। ওই টাকাই সম্বল। বাকি দুই হাজার পিস তরমুজ নিয়ে এসেছি আজ দুই দিন। ক্রেতা নেই। ট্রলারেই পচছে তরমুজ। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। আর চাষাবাদের কোনো সামর্থ্য রইলো না।

চরফ্যাশন উপজেলার মুজিবনগরের বাসিন্দা ইমাম হোসেন বলেন, আমি ২৭ একর জমিতে ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে তরমুজ চাষ করেছিলাম। তিন হাজার পিসের মতো তরমুজ টিকেছে। এখন ক্রেতার অভাবে আড়তে আর ট্রলারে সেগুলোও পচে যাচ্ছে। সরকার যদি এখন আমাদের ঋণের ব্যবস্থা না করেন তাহলে চাষাবাদতো দূরের কথা এলাকায়ও থাকতে পারব না।

চরবোরহান থেকে তরমুজ নিয়ে আসা ট্রলারের মাঝি ইউসুফ আলী বলেন, আজ চার দিন হলো বরিশালের কলাপট্টি ঘাটে ট্রলার বাঁধা। চাষি অনেক চেষ্টা করছেন তরমুজগুলো বিক্রি করে দেওয়ার। কিন্তু ক্রেতা নেই। চার দিনে কেউ এসে জিজ্ঞেস করেনি তরমুজের দাম কত? অনেক তরমুজ ট্রলারে পচে গেছে। দেখে দেখে আমরা নদীতে ফেলে দিচ্ছি। ক্রেতার জন্য চাষি ও আড়তদার হাহাকার করছেন।

পটুয়াখালীর দশমিনা থেকে আসা তরমুজ চাষি মোহন বলেন, আমার চার লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। সাড়ে চার হাজার পিস তরমুজ হয়েছিল। বৃষ্টিতে তিন হাজার পিসের মতো পঁচে গেছে। বরিশালের আড়তে মাত্র দেড় হাজার পিস নিয়ে আসতে পেরেছি।

একটি আড়তের কর্মচারী রফিকুল ইসলাম বলেন, মাঝারি ও বড় আকৃতি মিলিয়ে ৩০০ তরমুজের দাম কমপক্ষে ১২ হাজার টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে একজন বলে গেছেন আড়াই হাজার টাকা।

কুষ্টিয়া থেকে আসা পাইকার রুস্তম আলী গাজী বলেন, প্রতিটি তরমুজ পরীক্ষা করে নিতে হচ্ছে। যে তরমুজটি পচা সেটি ফেলে দেই। তারপর সংখ্যা গুনে দরদাম করে টাকা দেই। একই ক্ষেতের তরমুজ কিছু পচে গেছে, কিছু ভালো আছে। কুষ্টিয়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরও অনেক তরমুজ পচে যাবে।

লঞ্চঘাট এলাকার খুচরা তরমুজ বিক্রেতা বাদল মিয়া বলেন, পিস হিসেবে আড়ত থেকে তরমুজ কিনে এনে নগরীতে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করলেও এখন আর মানুষ কিনতে চাইছে না। পোর্ট রোড আড়তে চাষিরা বসে বসে কাঁদেন। মাল পচে যাচ্ছে, ক্রেতা নেই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খামার বাড়ি বরিশাল থেকে জানানো হয়েছে, চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি তরমুজ আবাদ হয়েছে। বরিশাল জেলায় তরমুজ চাষে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭০০ হেক্টর জমিতে, আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৪৬ হেক্টর জমিতে। পিরোজপুরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০৬ হেক্টর জমিতে, ১১৬ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। ঝালকাঠিতে লক্ষ্যমাত্রা না থাকলেও ৫৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে। পটুয়াখালীতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ না হলেও আবাদ হয়েছে ২৮ হাজার ৭৪৫ হেক্টর জমিতে। বরগুনায় ১১ হাজার ৫১২ হাজার হেক্টর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আবাদ হয়েছে ১৫ হাজার ৮৩৮ হেক্টর জমিতে। ভোলায় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ হাজার ২৪৯ হেক্টর জমিতে, ১৮ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন