টাকার ব্যবসা করা জায়েজ কি?

শরিয়তের দৃষ্টিতে একই প্রকারের দুইটি জিনিসকে কমবেশি ক্রয়-বিক্রয় করলে সুদ হয়ে যায়। সে কারণে এমন লেনদেন নাজায়েজ ও নিষিদ্ধ। তবে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের দুইটি জিনিস যদি কম-বেশিতে ক্রয়-বিক্রয় করা হয়, তাহলে এটি ‍সুদের অন্তর্ভুক্ত হয় না; তাই এই ধরনের ব্যবসা বৈধ।

সাধারণত মুদ্রার লেনদেন দুইভাবে হতে পারে। যথা- এক. ভিন্ন দেশের কারেন্সির লেনদেন। দুই. একই দেশের কারেন্সির লেনদেন। প্রথম প্রকারের লেনদেনকে ফরেক্স বলা হয়। মানে ভিন্ন দুইটি দেশের মুদ্রার লেনদেনকেই ফরেক্স বলা হয়।

এক. ভিন্ন দেশের কারেন্সির লেনদেন

এক দেশের কারেন্সি আরেক দেশের কারেন্সির বিনিময়ে কম-বেশি করে বিক্রি করা জায়েজ আছে। তবে এক্ষেত্রে বৈঠকেই কমপক্ষে একপক্ষ টাকাটি হস্তগত করে নিতে হবে। যদি একজনও তাদের বিনিময়কৃত কারেন্সি হস্তগত না করে, তাহলে ক্রয়-বিক্রয়টি জায়েজ হবে না। (জাদিদ ফিকহি মাসায়িল : ৪/২৮; জাদিদ মুআমালাত কে শরয়ি আহকাম : ১-১৩৯)

এক দেশের মুদ্রা ভিন্ন দেশের মুদ্রার সাথে প্রকার ভিন্ন হওয়ার কারণে কম-বেশিতে ক্রয়-বিক্রয় করা জায়েয আছে; যদি কমপক্ষে কোনো এক পক্ষ মুদ্রার ওপর কবজা করে থাকে। অন্যথায় তা অবৈধ। পক্ষান্তরে দেশি মুদ্রা একই প্রকারের হওয়ার কারণে পরস্পর কমবেশিতে ক্রয়-বিক্রয় শরিয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। অতিরিক্ত অংশ সুদ হিসেবে গণ্য হবে। (আদদুররুল মুখতার ৫/১৭১-১৭২; বুহুসুন ফি কাজায়া ফিকহিয়্যা : ১/১৬৩)

উপরোক্ত নিয়মে মুদ্রা-বিনিময় ব্যবসা জায়েয। তবে শর্ত হলো: একই বৈঠকে প্রদান ও গ্রহণ সম্পাদিত হতে হবে। ডলারের বিনিময়ে ইউরো বিক্রি করা জায়েয; শর্ত হলো- একই বৈঠকে গ্রহণ ও প্রদান সংঘটিত হতে হবে।

 

প্রসঙ্গত, দুই দেশের নোটের বিনিময় ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল’ কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যর ভিত্তিতেই হওয়া চাই। যেমন- এক ডলার (ইউএস) সমান বর্তমানে ৮৪ টাকা। তাছাড়া উভয়ে যদি কম-বেশির ওপর সম্মত হন, তাহলে সেটাও জায়েজ। তবে শর্ত হলো- উভয়ের যে কেউ একজন মজলিসে মুদ্রা হস্তগত করবেন।(জাদিদ ফিকহি মাসায়িল : ৪/২৮)

দুই. একই দেশের কারেন্সির লেনদেন

একই দেশের কারেন্সির পরস্পর লেনদেনের সময় সমতা রক্ষা করা আবশ্যক। কম-বেশি করে বিক্রি করলে উক্ত ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ হবে না। (হিদায়া, কিতাবুল বুয়ু, বাবুর রিবা : ০৩/৮৫; মুসতাদরাক আলাস সাহিহাইন : ০২/৬৫-৬৬; শারহু মাআনিল আসার : ৫৫৫৪; সুনান দারু কুতনি : ৩০৬০)

যেমন এক ডলারের বিনিময়ে দুই ডলার, এটা জায়েয নেই। যেহেতু এটি রিবাল ফাদল (বৃদ্ধিগত সুদ)। তাই যদি একই মুদ্রার বিনিময় হয়, তাহলে উভয়টি সমান সমান হওয়া ও একই মজলিসে আদান-প্রদান সম্পাদিত হওয়া আবশ্যক।

এর দলিল হচ্ছে উবাদা বিন সামেত (রা.)-এর হাদিস। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন- ‘স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, লবণের বিনিময়ে লবণ— সমান সমান ও হাতে হাতে হওয়া। আর যদি শ্রেণীগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়, তাহলে যেভাবে ইচ্ছা— সেভাবে বিক্রি করতে পার; যদি হাতে হাতে হয়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৫৮৭)

হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘নগদ নগদ না হলে স্বর্ণের বদলে স্বর্ণের বিক্রয় সুদ হবে। নগদ নগদ ছাড়া গমের বদলে গমের বিক্রয় সুদ হবে। নগদ নগদ ছাড়া যবের বদলে যবের বিক্রয় সুদ হবে। নগদ নগদ না হলে খেজুরের বদলে খেজুরের বিক্রয় সুদ হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০৩৯)

হুন্ডির ব্যবসা করা কি জায়েজ?

কালোবাজারি বা হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন করা জায়েজ। তবে এক্ষেত্রে সরকারি বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করা হয়ে থাকে। অথচ বৈধ বিষয়ে সরকারি বিধিবিধানের অনুসরণ অত্যাবশ্যকীয়। সে কারণে কালোবাজারি পরিত্যাগই শ্রেয়। তবে এরপরও কেউ এভাবে লেনদেন করে থাকলে, তা হারাম বা নাজায়েয হবে না। হুন্ডির মাধ্যমে কেউ করে নিলে, সেটা বৈধ হবে। যদি তাতে ধোঁকা ও প্রতারণা না থাকে। (জাদিদ মুআমালাত কে শরয়ি আহকাম : ১-১৩৯)

মুদ্রা-ব্যবসা সম্পর্কে শায়খ বিন বাজের ফতওয়া

শাইখ বিন বাজের ফতোয়াসমগ্রতে এসেছে, “মুদ্রাগুলোর মধ্যে বেচাকেনার লেনদেন জায়েজ। কিন্তু শর্ত হলো- আদান-প্রদান হাতে হাতে সম্পাদিত হওয়া; যদি মুদ্রাগুলো আলাদাশ্রেণীর হয়। তাই কেউ যদি লিবিয়ান মুদ্রার বিপরীতে আমেরিকান মুদ্রা বিক্রি করে কিংবা মিসরী মুদ্রা বা অন্য কোনো মুদ্রার বিপরীতে বিক্রি করে এবং হাতে হাতে বিনিময় হয়, তাহলে কোনো অসুবিধা নাই। যেমন- কেউ লিবিয়ান মুদ্রা দিয়ে নগদে কিছু ডলার কিনল। একই মজলিসে সে এটি গ্রহণ করল এবং অন্যজন অন্যটি গ্রহণ করল। কিংবা মিসরি মুদ্রা কিংবা ইংল্যাণ্ডের মুদ্রা কিংবা অন্যকোনো মুদ্রা লিবিয়ান মুদ্রার বিনিময়ে খরিদ করল— হাতে হাতে; এতেও কোনো অসুবিধা নেই। আর যদি বাকিতে খরিদ করে, তাহলে জায়েজ হবে না। অনুরূপভাবে একই মজলিসেও যদি একহাতে দেওয়া অন্য হাতে নেওয়া সংঘটিত না হয়, তাহলেও জায়েজ হবে না। কেননা সেটি এক প্রকার সুদি কারবার। তাই অবশ্যই একই মজলিসে হাতে হাতে সংঘটিত হতে হবে; যদি মুদ্রাগুলো ভিন্ন শ্রেণীর হয়। আর যদি এক শ্রেণীর হয় তাহলে দুটো শর্ত পূর্ণ হতে হবে: সমান সমান হওয়া এবং একই মজলিসে এক হাতে নেওয়া অন্য হাতে দেওয়া। দলিল হচ্ছে নবী (সা.)-এর হাদিস, ‘স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য…’।” (ফতওয়াসমগ্র, শায়খ বিন বাজ : ১৯/১৭১-১৭৪)

অতএব, মুদ্রা ব্যবসার হুকুম হলো- যেমনটা আগে উল্লেখ করা হয়েছে। যদি আলাদা শ্রেণীর হয়, তাহলে একই মজলিসে হাতে হাতে আদান-প্রদানের সঙ্গে— বেশি বা কমে বিনিময় করা জায়েজ। আর যদি একই শ্রেণীর হয়, যেমন- ডলারের বিনিময়ে ডলার কিংবা দিনারের বিনিময়ে দিনার; সেক্ষেত্রে একই মজলিসে এক হাতে আদান ও অন্য হাতে প্রদান এবং সমান সমান হওয়া শর্ত।

আল্লাহ তাআলা আমাদের হালাল ব্যবসার তাওফিক দান করুন।

 

আপনি আরও পড়তে পারেন