নষ্ট হয়ে গেছে বীজতলা, মাঠে মাঠে কৃষকের কান্না

নষ্ট হয়ে গেছে বীজতলা, মাঠে মাঠে কৃষকের কান্না

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিতে বাগেরহাটের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েন জেলার লক্ষাধিক মানুষ। ভেসে যায় পুকুর-ঘের। অবিরাম বৃষ্টিতে ফসলি জমি, বীজতলা, আমন ধান, সবজি, পানসহ বিভিন্ন ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। অতি বর্ষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমনের বীজতলা। পঁচে যাওয়া বীজতলার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছেন চাষিরা। জলাবদ্ধতায় অন্তত ৮০ ভাগ বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে বলে দাবি কৃষকদের।

এদিকে শরণখোলায় পানি না নামায় বাঁধ কেটে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি থেকে পানি নামানোর ব্যবস্থা করে উপজেলা প্রশাসন। এর পরেই দৃশ্যমান হতে থাকে ক্ষয়ক্ষতি।

শরণখোলা উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, শরণখোলায় মোট ১১ হাজার ২৯০ জন চাষির মাধ্যমে এবার ৯ হাজার ৪৩৯ হেক্টর জমিতে আমন চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সে লক্ষ্যে বিআর-১১, বিআর-৫২ ও বিআর-২২ জাতের ধান চাষের জন্য ৭৩০ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়।

তবে শুধু শরণখোলা নয়, রামপাল, মোংলা, মোড়েলগঞ্জেরও অধিকাংশ এলাকায় বীজতলা নষ্ট হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন কৃষকরা। বীজ সংকট থেকে উত্তোরণের জন্য সরকারি সহায়তার দাবি করেন এসব এলাকার কৃষক।

বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২৭ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে জেলায় এক হাজার ৫৮৮ হেক্টর রোপা আমনের বীজতলা নষ্ট হয়েছে। ৯৬০ হেক্টর জমির আউশ ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গ্রীষ্মকালীন সবজির ক্ষতি হয়েছে ৩৭৯ হেক্টর জমির। সাড়ে ১০ হেক্টর জমির পান বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ২০ হাজার ২০৩ জন কৃষকের পাঁচ কোটি ৬৫ লাখ তিন হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।

শরণখোলা উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়নের পশ্চিম রাজৈর গ্রামের চাষি মো. সাইয়েদ আলী জানান, তার ১০ কাঠা জমির বীজতলা সব নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে বীজতলা তৈরির জন্য ডিলারের কাছে বীজ ধান কিনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো ডিলারের কাছে বীজ ধান পাইনি। সামনের দিনগুলো খুব কষ্টে কাটবে।

উত্তর তাফালবাড়ী এলাকার নাছির উদ্দিন পাহলান নামে এক চাষি বলেন, ২০ বিঘা জমিতে আমন ধান লাগানোর জন্য একশ কেজি বীজ ধান বুনেছিলাম। জলাবদ্ধতায় ধানের চারাগুলো (পাতো) বেশির ভাগ পচে গেছে। শিকড়েও পচন ধরেছে।

সাউথখালী ইউনিয়নের খুড়িয়াখালী গ্রামের আলম নামে এক কৃষক জানান, বৃষ্টির ফলে ২০ কেজি ধানের বীজতলা পানিতে নিমজ্জিত থাকায় পচে নষ্ট হয়ে গেছে। যার ফলে এবার আর আমন চাষ করা সম্ভব নয়। নতুন ধান চাষাবাদের জন্য অনেক জায়গায় যোগাযোগ করেও বীজ সংগ্রহ করতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত জমি পতিত থাকবে বলে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি।

একই ইউনিয়নের মো. জহির খলিফা বলেন, চার বিঘা জমিতে আমনের বীজতলা করেছিলাম। সবই শেষ হয়ে গেছে। পঁচা বীজতলা হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

মোড়েলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া ইউনিয়নের ফুলহাতা গ্রামের কৃষক রাকিব হাসান বলেন, ৬ বিঘা জমির বীজতলা সবই নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের এলাকায় মাছ এবং এক ফসলি আমন ছাড়া তেমন কিছুই হয় না। নতুন করে চাষের জন্য অনেক জায়গায় ঘুরেও একমুঠো বীজ পাইনি। এই ক্ষতি কিভাবে পুষিয়ে উঠবো ভেবে পাচ্ছি না।

শরণখোলা উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজারের ডিলার মেসার্স শহিদুল এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. শহিদুল ইসলাম জানান, উপজেলার বিএডিসি অনুমোদিত চারজন ডিলার এলাকার চাহিদা অনুযায়ী বিআর-৫২, বিআর-২২ ও বিআর-১১ এই তিন জাতের ৪৫ টন বীজ ধান উত্তোলন করেন। এসব বীজ ধান ৩০ জুনের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে। তাদের কারো কাছেই বীজ ধান নেই। এখন সরকারিভাবে এই সংকট সমাধানের ব্যবস্থা নিতে হবে।

মোড়েলগঞ্জ উপজেলার ভাই ভাই স্টোরের স্বত্বাধিকারী বীজ ধানের ডিলার সুখদেব হালদার বলেন, আমাদের এ বছর চাহিদা ছিল দশ টনের মতো। কিন্তু আমরা বরাদ্দ পেয়েছি মাত্র সাড়ে তিন টন বীজ ধান। সম্প্রতি বৃষ্টিতে বীজধান নষ্ট হয়ে যাওয়াতে আমাদের কাছে অনেক কৃষক এসেছেন। কিন্তু আমরা কাউকে বীজ দিতে পারছি না।

শরণখোলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আছাদুজ্জামান মিলন জানান, বৃষ্টির পানিতে বীজতলাগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে উপজেলাজুড়ে কৃষকরা এখন হতাশায় রয়েছেন। নতুন করে চাষাবাদের জন্য কৃষকদের দ্রুত সরকারি সহায়তার দাবি জানান তিনি।

সরকারি বীজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিএডিসির (বীজ) বাগেরহাট কার্যালয়ের সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা আকলিমা খাতুন বলেন, কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী ৫০ টন বীজ বরাদ্দ ছিল। আমরা ৫০ টনেরও কিছু বেশি বীজ এই মৌসুমে কৃষকদের সরবরাহ করেছি। কিন্তু এখন নতুন করে আর বরাদ্দের সুযোগ নেই।

বীজ ধানের সংকট প্রসঙ্গে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ওয়াসিম উদ্দিন বলেন, এই মুহূর্তে স্থানীয়ভাবে বীজধান সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করছি। সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে দ্রুত বীজ ধান পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, বীজতলা নষ্ট হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের তালিকা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হয়েছে। সরকারি সহায়তা এলে কৃষকদের সাহায্য দেওয়া হবে। পাশাপাশি ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমরা কৃষকদের নানা পরামর্শ দিচ্ছি। এ ছাড়া বীজ ধান সংগ্রহের বিষয়ে আমরা কাজ করছি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খুলনার অতিরিক্ত উপপরিচালক জিএমএ গফুর বলেন, আমি বাগেরহাটের ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছি। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের সঙ্গে কথাও বলেছি। জরুরি ভিত্তিতে অন্য এলাকা থেকে বীজধান সংগ্রহ করে সংকট সমাধানের চেষ্টা চলছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন