নিওনাজির প্রত্যাবর্তন : সন্ত্রাসীর কোনো দেশ নেই

বিশ বছর আগে যখন জার্মানিতে বসবাস করতাম, তখন আমি একেবারেই শিশু। ওই সময় নিওনাজি বা স্কিনহেড শব্দগুলো প্রায়ই শোনা যেতো। বাদামি রঙের যেকোনো মানুষই তখন আতঙ্কে থাকতো যে, এই বুঝি তাদের ওপর নিওরা হামলা চালালো! বিশ্ব এরপর অনেক এগিয়ে গেছে।  কিন্তু  ‘নিও’ শব্দটির প্রকৃতি এখনও অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে।

১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ এলাকার মসজিদে গোলাগুলিতে অন্তত পঞ্চাশজন নিহত ও বিশজন গুরুতর আহত হয়েছে। মসজিদ এমন একঘর যেখানে গিয়ে মানুষ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানায়, আশ্রয় চায় ও আত্মসমর্পণ করে। অথচ সেই ঘরেই আটাশ বছর বয়সী এক অস্ট্রেলিয়ান শ্বেতাঙ্গ যুবক নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে হত্যা করলো নারী, পুরুষ ও শিশুদের। ২০১৭ সালে স্টকহোমে এক লরিতে সন্ত্রাসী হামলায় এবা আকারলাউন্ড নামের এগারো বছর বয়সী শিশু হত্যার প্রতিশোধ নিতেই নাকি এ হামলা চালিয়েছে সে। এবার বাবা জানিয়েছেন, তার মেয়ের নামে এ ধরনের জঘন্য হত্যাকা- চালানোয় তিনিও গভীরভাবে ক্ষুব্ধ। হামলায় তিন বাংলাদেশি ও নিউজিল্যান্ড জাতীয় ফুটবল টিমের এক খেলোয়াড় নিহত হয়েছেন। ছোট ওই মসজিদে সত্তর-আশিজনের মতো মুসল্লি ছিলো। ফলে তারা সহজেই বন্দুকধারীর শিকারে পরিণত হয়েছে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলোÑহামলার আগে সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ৭৮ পৃষ্ঠার ঘোষণাপত্রে হামলার কারণ ব্যাখ্যা করেছে, যেখানে সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী মনোভাব ও ঘৃণা প্রকাশ করেছে।

মজার বিষয় হলো ডয়েচে ভেল ও কয়েকটি গণমাধ্যম ছাড়া বেশিরভাগ গণমাধ্যমই এই হামলাকে সন্ত্রাসী হামলার পরিবর্তে গোলাগুলি বলে উল্লেখ করেছে। কারণ এই হত্যাকা-ের ঘটনাটি এক শ্বেতাঙ্গ ঘটিয়েছে। যদি এই ঘটনার সঙ্গে কোনো মুসলমানের নাম জড়িয়ে থাকতো তাহলেই এটি জঙ্গি হামলা হয়ে যেতো।

নিউজিল্যান্ড শান্তিকামী জাতি। সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মতো ঘটনার সঙ্গে তারা খুব কমই জড়িত। বর্তমান হামলাকারীর বিষয়েও পূর্বের অপরাধের কোনো রেকর্ড নেই পুলিশের কাছে। যার কারণে পুলিশ হামলাকারীর ওপর নজরও রাখতে পারেনি। তবে ক্রাইস্টচার্চের এ ঘটনায় আবারো প্রমাণিত হলো যে, মানব ঘটিত দুর্যোগ থেকে মানবতার জন্য অনেক ভালো কিছুও হতে পারে। যেমন : মালালা ইউসুফজাই সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, পাকিস্তানের সেই খাইবার পাকতুনখোয়া প্রদেশের এক ব্যক্তি এদিন সন্ত্রাসীকে রুখতে তার বন্দুক কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে অসাধারণ সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন। আর একজন বালক, যে সেই মসজিদেই কাজ করতো, সেও ওই সন্ত্রাসীকে বাধা দেয়। তার কাছ থেকে একটা বন্দুক পর্যন্ত কেড়ে নেয় সে। শেষ পর্যন্ত এই দুইজন জীবন দিলেও তাদের এই সাহসী প্রচেষ্টার কারণে সেখানে মৃতের সংখ্যা হয়তো কিছুটা কম হয়েছিলো।

অসাধারণ এই ঘটনাগুলো আমাদের মানবিকতার জয়ের কথা বলে, অন্ধকারে আশার আলো জ্বালায়। এই ঘটনাগুলো আমাদের ২০১৬ সালের ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজানের সেই ভয়ংকর হত্যাকা-ের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেদিনও বিশ বছর বয়স্ক ফারাজ হোসেন তার বন্ধুদের ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিজের জীবন দিয়েছিলো।

আমরা বিশ্বাস করি পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ ধর্ম বা গয়ের রঙের কারণে কাউকে ঘৃণা বা আঘাত করে না। এর প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই সন্ত্রাসী হামলার সেই জায়গায় ফুল ও মোমবাতি দিয়ে মানুষের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের দৃশ্য দেখেই। এর প্রতিফলন দেখি, এই লেখা যখন লিখছি, তখন ল-নে চলমান বর্ণবাদবিরোধী র‌্যালির মধ্যে। এই প্রতিকূল সময়ে নিউজিল্যান্ডের শান্তিকামী মানুষরা যখন প্রার্থনা করে, তাদের হৃদয়েও তখন এই শান্তির বাণীই উচ্চারিত হয়। এর প্রতিফলন আমরা দেখি পৃথিবীর সেসব মানুষের মধ্যে যারা বিশ্বাস করে সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসীর কোনো দেশ নেই, কোনো ধর্ম নেই।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment