পঞ্চগড়ে সার-সংকট, তবে টাকা দিলেই মিলছে

পঞ্চগড়ে সার-সংকট, তবে টাকা দিলেই মিলছে

সারা দেশের ন্যায় উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে চলছে আমন ধানের চারা রোপণের মৌসুম। কৃষকরা যেখানে প্রতিবছর মৌসুমের শুরুতে আমনের চারা রোপণে ব্যস্ত সময় পার করতেন, সেখানে চলতি মৌসুমে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। কৃষকরা আমনের চারা রোপণের শুরুতে সার ব্যবহার করলেও হঠাৎ দেখা দিয়েছে সারের সংকট।

কৃষকরা কয়েক দিন ধরে ডিলার ও বিক্রেতাদের দোকানে ঘুরেও পাচ্ছেন না সার। কিছু কৃষক সার পেলেও গুনতে হচ্ছে সরকারি-নির্ধারিত দামের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দাম। সঠিক সময়ে আমনের আবাদে সার প্রয়োগ করতে না পারলে উৎপাদন কম হবে বলে হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন জেলার পাঁচ উপজেলার সাধারণ কৃষকরা।

কৃষকদের অভিযোগ, সারের ডিলার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে খুচরা স্যার ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে কৃত্রিমভাবে সারের সংকট তৈরি করে বেশি মুনাফা লাভের আশায় এই সংকট তৈরি করা হয়েছে। ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট টিএসপি, ডিএপি (ডাই-অ্যামোনিয়ায় ফসফেট), এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সারের দাম সরকার নির্ধারণ করে দিলেও ডিলার ও ব্যবসায়ীরা বেশি দামে সার বিক্রি করছেন। সারের জন্য স্লিপ নিয়ে ডিলারদের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়লেও সার পাচ্ছেন না কৃষকরা।

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি মৌসুমে পঞ্চগড়ের সদর, বোদা, দেবীগঞ্জ, আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় উফশী, হাইব্রিড ও স্থানীয় জাতের ৯৯ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৮৫ হাজার হেক্টর জমিতে চারা রোপণ করা হয়েছে। অধিদপ্তর বলছে, পঞ্চগড়ে ধানের আবাদ বেশি হওয়ায় পর্যাপ্ত পরিমাণে সার বরাদ্দ পাওয়া গেছে।

তবে কৃষকরা বলছেন, ডিলার ও সার ব্যবসায়ীদের কাছে সার কিনতে গেলে তারা সার দিচ্ছেন না। ডিলার ও সার ব্যবসায়ীরা বলছেন, সার পাওয়া যাচ্ছে না। তবে দাম বেশি দিতে চাইলে সার বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। এতে দেওয়া হয় না রসিদ। আর যেসব কৃষককে রসিদ দেওয়া হচ্ছে, তাদের সরকারি দামের রসিদ ধরিয়ে দিয়ে গোপন রাখতে বলে দিচ্ছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতি বস্তা টিএসপি সারের দাম ১ হাজার ১০০ টাকা সরকার নির্ধারণ করলেও বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ টাকায়, ইউরিয়া প্রতি বস্তা ৮০০ টাকার পরিবর্তে ১ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ডিএপি (ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট) ৮০০ ও এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) ৭৫০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর বাধ্য হয়ে কৃষকদের সার কিনতে হচ্ছে অতিরিক্ত দামে। এ ছাড়া জমাট বাঁধা সার ও নষ্ট সার নতুন বস্তায় প্যাকেট করে কৃষকদের কাছে বিক্রি করছেন ডিলার ও সাধারণ সার ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে, সরকারি বিধি অনুসারে প্রতি ইউনিয়নের স্থানীয় ব্যক্তিদের সারের ডিলার হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও জেলার অধিকাংশ ইউনিয়নের অন্য ইউনিয়ন ও উপজেলার ব্যক্তিদের ডিলার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব ডিলার অন্য উপজেলা বা ইউনিয়নে বাস করলেও ডিলারশিপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নে জমি কিনে বাড়ি দেখিয়ে ডিলারশিপের লাইসেন্স গ্রহণ করেছেন।

অতি মুনাফার আশায় এসব ডিলার সারের দাম নিয়ন্ত্রণ করেন। সরকারি নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সিন্ডিকেট করে, কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন। জেলার পাঁচ উপজেলায় মোট বিএডিসির ১৬০ জন এবং বিসিআইসির ৪৭ জন ডিলার রয়েছেন। তবে তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিসিআইসির ডিলারদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও পঞ্চগড় ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল হান্নান শেখ।

এ বিষয়ে জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার বুড়াবুড়ি হারাদিঘী এলাকার কৃষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা ধরে শালবাহান হাইস্কুল মাঠে সারের স্লিপের জন্য অপেক্ষা করেও না পেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। বেশি দামে সার কিনলে পাওয়া যায় আর সরকারি নির্ধারিত দামে সার কিনলে ডিলার ও ব্যবসায়ীরা বলেন সার নাই। এ কারণে আমি আমার আমন ধানের চারা রোপণ করতে পারিনি।

একই কথা হাসিবুল ইসলামের। তিনি বলেন, পাঁচ বিঘা জমিতে আমন ধানের চারা রোপণ করেছি। এখনো সার দিতে পারিনি। যাদের প্রভাব আছে, তারা রাতে নিয়ে যায় আর আমরা কৃষকরা কয়েক দিন ঘুরেও সার পাই না। দোকানে গেলেই বলে সার নাই। আবার বেশি দাম দিলে বলে সার আছে। আমরা কৃষকরা আজ অসহায় হয়ে গেছি। কেউই বিষয়টি দেখছে না।

বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও পঞ্চগড় ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল হান্নান শেখ অতিরিক্ত দামে সার বিক্রির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, পঞ্চগড়ে সারের কোনো ঘাটতি নেই। নতুন করে সার বরাদ্দ পাওয়া গেছে। অতিরিক্ত দামে কোথাও সার বিক্রি হচ্ছে না।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, পঞ্চগড়ে সার সংকট হওয়ার কথা নয়। আগস্ট মাসের জন্য অতিরিক্ত দুই হাজার মেট্রিক টন সার বরাদ্দ এসেছে। কৃষকদের শুধু টিএসপি ব্যবহার না করে ডিএপি সার ব্যবহারের পরামর্শ কৃষি বিভাগ থেকে দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, সারের সংকট যেন না হয়, তার জন্য আমরা তদারক করছি। যারা সারের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম নিচ্ছেন, প্রমাণসহ অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আপনি আরও পড়তে পারেন