পাই Π দিবসে শুভেচ্ছা জানাই কল্যাণের পথে বাজাই সানাই

আজ সোমবার ১৪ মার্চ , বিশ্ব পাই (π) দিবস।  পাই (বড় হাতের অক্ষরটি Π, ছোট হাতের অক্ষরটি π) গ্রিক বর্ণমালার ষোলতম অক্ষর।  গ্রিক সংখ্যা ব্যবস্থায় পাইয়ের মান হল ৮০। সর্বপ্রথম ১৬৪৭ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ গণিতবিদ  তার প্রকাশিত বই ক্ল্যাভিস ম্যাথেমেটিক এবং পরবর্তী সংস্করণগুলোতে δ/π কে বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতরূপে প্রকাশ করেন।

গ্রিক শব্দ ‘περιφέρεια’ (যার অর্থ periphery) এবং ‘περίμετρος’(যার অর্থ perimeter) এর প্রথম বর্ণ হচ্ছে π । ধারণা করা হয় পরিধি বা perimeter শব্দটি থেকেই π এর ব্যবহার হয়ে আসছে।

২০০৯ খ্রীষ্টাব্দে ১২ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র সরকার ১৪ মার্চকে জাতীয় পাই (π) দিবস হিসেবে পালনের অনুমোদন দেয়।

বাংলাদেশে পাই (π) দিবস উদযাপিত হচ্ছে ২০০৬ সাল থেকে। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির উদ্যোগে দেশে এই দিবস উদযাপন শুরু হয়। দেশের বেশ কিছু গণিত ক্লাব ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা আয়োজনের মধ্যে দিবসটি পালিত হয়।

১৭০৬ খ্রীষ্টাব্দে সর্বপ্রথম গণিতবিদ উইলিয়াম জোনাস তাঁর “এ নিউ ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথম্যাটিকস” ( A New Introduction to Mathematics) বইতে প্রথম ধ্রুবক প্রকাশে পাইকে ব্যবহার করেন। যদিও তার এই মতবাদ তৎকালীন অনেক গণিতবিদেরা গ্রহণ করেননি।

১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দে সুইস গণিতবিদ লিওনার্দো ইউলার এই প্রতিকটিকে গ্রহণ করার পর পাই প্রতিকটি কিছুটা জনপ্রিয়তা পায়। ১৭৬৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত অনেকেই পাইকে প্রকাশ করার জন্য ভগ্নাংশই ব্যবহার করতেন।

১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দে জহান হেনরিখ ল্যাম্বাট সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন যে পাই একটি অসীম দশমিক বর্ধন  সংখ্যা। এর বর্ধন শেষ হওয়ার নয়। এর মান চলমান। সাধারণত দশমিকের পরে তিন ঘর নেওয়া হয়ে থাকে। তবে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে গবেষণার ক্ষেত্রে সুক্ষ ফলাফলের জন্য দশমিকের পর বারো থেকে পনের ঘর পর্যন্ত নিয়ে থাকেন।

বহু গণিতবিদ পাই এর মান দেখে চমকে গেছেন। পাই এর মান অনেক সময় গণিতবিদদের বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছে। বহু গণিতবিদের জল্পনা-কল্পনা ও গবেষণার শেষ নেই। সুপার কম্পিউটার ব্যবহার করে দশমিকের পর লক্ষ কোটি ঘর পর্যন্ত হিসাব করে এর কোন পুনরাবৃত্তি তাঁরা পাননি। পাই একটি অমূলদ সংখ্যা।

এছাড়াও গণিতের বিভিন্ন অপারেটর, রসায়নে, মেকানিক্স এবং তরল গতিবিদ্যায়, বীজগণিত টোপোলজিতে এমনকি অর্থনীতির বিভিন্ন রাশি প্রকাশে π প্রতীকটি ব্যবহার করা হয়।

পাই  সম্পর্কে মজার বিষয় হল বৃত্ত যত বড় বা ছোট হোক না কেন পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত সর্বক্ষেত্রে একই। আজ পাই দিবস উপলক্ষে পাই সংক্রান্ত কিছু অদ্ভুদ ও মজাদার তথ্য সম্পর্কে আলোচনা করি, যা জেনে আশ্চর্য হবেন।

১. ২৫০ বছর ধরে π প্রতিকটি ব্যবহার করা হচ্ছে।

২. পাইয়ের প্রকৃত মান গণনা করা যায় না, ফলে বৃত্তের সঠিক এলাকা বা পরিধি খুঁজে পাওয়া যায় না।

৩. মার্চ ১৪ বা ৩/১৪ বিশ্ব পাই দিবস হিসাবে উদযাপন করা হয়। কারণ ৩.১৪ পাই এর প্রথম সংখ্যা। সারা বিশ্ব জুড়ে গণিত ভক্তরা এই সংখ্যাটি উদযাপন করেন।

৪. পাই দিবস কখনো কখনো ১৪ই মার্চ দুপুর ১টা ৫৯ মিনিটে উদযাপন করা হয় । এই দিন দুপুর ১টা ৫৯ মিনিট ২৬ সেকেন্ডকে পাই সেকেন্ড বলা হয় । পাই সেকেন্ডে পাই দিবস পালনের মধ্য দিয়ে পাইয়ের মানের (৩.১৪১৫৯২৬) কাছাকাছি সময়ে দিবসটি উদযাপন করা সম্ভব হয় ।

৫. পাই একটি অমূলদ সংখ্যা, বিধায় প্রকৃত মান বের করা যায় না।

৬. পাইকে ধারা এবং অ্যালগরিদমের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়।

৭. পাই মিশরীয় পৌরাণিক কাহিনীরও একটি অংশ। মিশরের লোকেরা বিশ্বাস করত যে গিজার মহা পিরামিডগুলি পাই-এর নীতিতে নির্মিত হয়েছিল। পিরামিডের উলম্ব উচ্চতা ও এর পরিসীমার অনুপাত অনেকাংশে বৃত্তের ব্যাসার্ধ ও এর পরিধির অনুপাতের সমান। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এই পিরামিডগুলি সারাবিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষণ করে। সুতরাং এর মূলনীতি হিসাবে π থাকার ব্যাপারটি সত্যিই স্থাপত্যবিদদের জন্য আকর্ষনীয় করে তোলে।

৮. ভগ্নাংশের বিবেচনায় পাই দিবস ২২-এ জুলাই (২২/৭) উদযাপিত  হতে পারে।

৯. ১০-ই নভেম্বর পাই দিবস উদযাপিত হতে পারে, যা কিনা বছরের ৩১৪-তম দিন (অধিবর্ষ বা লিপ ইয়ারের ক্ষেত্রে ৯-ই নভেম্বর)।

১০. পদার্থবিজ্ঞানী ল্যারি শো সান ফ্রান্সিসকোর এক্সপ্লোরেটোরিয়াম বিজ্ঞান জাদুঘরে ১৪ মার্চকে সর্বপ্রথম পাই দিবস পালন করেন । সেজন্য তাকে প্রিন্স অফ পাই বলা হয়।

১১. পাই নম্বরের উপর ভিত্তি করে তৈরি একটি সম্পূর্ণ ভাষা আছে। কিছু লোক পাইকে এতটাই ভালোবাসে, তারা ক্রমাগত শব্দের বর্ণগুলো সংখ্যা পাই এর সংখ্যার সাথে মিল রেখে একটি উপভাষা আবিষ্কার করে ফেলেন। মাইক কিথ এই ভাষাতে ‘Not a Wake’ নামে একটি সম্পূর্ণ বই লিখেছেন।

১২. অনেকগুলি রেকর্ড রয়েছে যা দেখায় যে, পাই আবিষ্কৃত হওয়ার অনেক আগেই বাবিলীয়রা প্রায় ৪০০০ বছর আগেই পাই সম্পর্কে জানত। প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বাবিলীয়রা পাইয়ের মান ৩.১৫ গণনা করেন।

১৩. অনেক প্রতিভাধর মানুষ পাই এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। আলবার্ট আইনস্টাইন পাই দিবসে জন্মগ্রহণ করেন।

১৪. ১৪৩ বছর পূর্বের আজকের এই দিনে সর্বকালের সেরা পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

১৫. ৭৬ বছর বয়সে স্টিফেন হকিংস ও পাই দিবসে মারা যান।

১৬. পাই সংখ্যাটি রহস্যময় এবং দীর্ঘ। ফলে গণিতবিদরা এখনও এই সংখ্যা নিয়ে গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

১৭. পাইটি রূপক অর্থে নয়, আক্ষরিকভাবে অসীম দীর্ঘ সংখ্যা।

১৮. পাই এর মান গণনার মাধ্যমে আমরা কম্পিউটারের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে পারি। এটি একটি ডিজিটাল কার্ডিওগ্রামের মতো কাজ করে কারণ এটি কম্পিউটারের প্রসেসরের বিভিন্ন কার্যক্ষমতার স্তরকে নির্দেশ করে।

১৯. এক্সপ্লোরেটোরিয়াম বিজ্ঞান জাদুঘরে, প্রতি বছর পাই দিবসে একটি বৃত্তাকার প্যারেড সংঘটিত হয়। অংশগ্রহণকারী সবাই পাইয়ের একটি করে সংখ্যা ধরে থাকে। পাই দিবস উদযাপন করার প্রধান উদ্দেশ্য হল সবাইকে গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহী করে তোলা।

২০. পাই নিয়ে চলচ্চিত্র Pi: Finding Faith in Chaos -এ পাই ও মহাবিশ্বের বিভিন্ন উত্তর খোঁজার ক্ষেত্রে নায়কের প্রচেষ্টাকে চিত্রিত করা হয়েছে। পাইয়ের প্রতি এই অনুসন্ধান তাকে পাগল করে ফেলে। কিন্তু ভাল ব্যাপার হল এই চলচ্চিত্রটি স্যান্ডেন্স চলচ্চিত্র উৎসবে পরিচালক পুরস্কার লাভ করেছে।

২১. প্রাচীনকালে, গণিতজ্ঞগণ পাই গণনা করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। তারা একাধিক বাহু বিশিষ্ঠ বহুভুজ ব্যবহার করে বৃত্তাকার এলাকায় পৌঁছেছেন। আর্কিমিডিস, সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রীক গণিতবিদ এবং আবিষ্কারক, ৯৬ বাহু বিশিষ্ঠ বহুভুজ ব্যবহার করেছিলেন। বহু অন্যান্য গণিতবিদগণ এই বহুভুজের পদ্ধতিতে পাইয়ের মান গণনা করেছেন। চীনে, একজন গণিতবিদ বহুভুজে প্রায় ২০০ এবং তারপরে ৩,০০০ টিরও বেশি বাহু ব্যবহার করে পাইয়ের মান ৩.১৪১৫৯ বের করতে সক্ষম হন!

২২. পাই এর ব্যবহার বছর এর পর বছর বিস্তিৃত হয়েছে। ১৭ শতকের আগে, পাই শুধুমাত্র বৃত্তাকার ক্ষেত্রের মানসমূহ বের করতে ব্যবহার করা হত। কিন্তু ১৭ শতকের মধ্যে, লোকেরা বুঝতে পেরেছিল যে বক্ররেখা এবং হাইপোসাইক্লয়েড সহ অন্যান্য ক্ষেত্রগুলি গণনা করতে পাই ব্যবহার করা যেতে পারে। ২০ শতকের মধ্যে, পাইটি সম্ভাব্যতা এবং বিভিন্ন গাণিতিক অ্যাপ্লিকেশনের জন্য ব্যবহৃত হয়।

২৩. পাইয়ের সংখ্যাগুলো গণনা করা কঠিন হলেও পাইয়ের মান দ্বারা অন্যান্য জিনিস গণনা করার ক্ষেত্রে এটি অনেক কার্যকর। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা দশমিকের পরে মাত্র ৯ ডিজিট নিয়ে পৃথিবীর পরিধি গণনা করার জন্য এটি ব্যবহার করি তবে ফলাফলগুটি অসাধারণভাবে সঠিক হবে। প্রতি ২৫,০০০ মাইলের জন্য শুধুমাত্র একটি ইঞ্চির চার ভাগের এক ভাগ ভুল হবে।

২৪. পাই এতই আশ্চর্যজনক এবং রহস্যময় যে এটি চলচ্চিত্রে রহস্যজনক পরিস্থিতিতে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৯৬ থ্রিলার চলচ্চিত্র টর্ন কার্টেনে, পাই হল গোপন কোড।

২৫. পাই এর ডিজিটসমূহ কে কার চেয়ে বেশি গণনা করতে পারে এ নিয়ে সর্বদা প্রতিযোগিতা চলছে। ২০১০ সালে জাপানী প্রকৌশলী এবং আমেরিকান কম্পিউটার উইজার্ড পাইয়ের ৫ ট্রিলিয়ান ডিজিট সংখ্যা গণনা করে সর্বাধিক সংখ্যক পাইয়ের ডিজিট গণনার রেকর্ডটি ভাঙ্গে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার তারা কোন সুপার কম্পিউটার ব্যবহার করেননি। তারা তাদের অসাধারণ কল্পনাশক্তি আর শুধু সাধারণ ডেস্কটপ কম্পিউটারের সাথে ২০টি এক্সটার্নাল হার্ডডিস্ক ব্যবহার করে এ মানটি বের করেন।

জিল ব্রিটলন পাই নিয়ে খুব সুন্দর একটি কবিতা লিখেছিলেন। এই কবিতার মাধ্যমে পাইয়ের মান ৩১ ঘর পর্যন্ত মুখস্ত করা সম্ভব। পাই নিয়ে এরচে চমৎকার কবিতা দ্বিতীয়টি নেই।

আপনি আরও পড়তে পারেন