পেটের আগুনেই পুড়ে গেল শিশুদের প্রাণ

পেটের আগুনেই পুড়ে গেল শিশুদের প্রাণ

নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জ ঃ

২০১০ সালের ১১ মার্চ মো. হাসনাইনের জন্ম। সেই হিসাবে তার বয়স হয়েছিল ১১ বছর ৪ মাস। এই বয়স যেকোনো শিশুর খেলার বয়স। অথচ বাবার অসুস্থতার কারণে চলতি বছরের শুরুতে হাসনাইনকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কারখানায় কাজে পাঠায় পরিবারটি। ৮ জুলাই উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় কারখানায় অগ্নিকা-ে নিহত ৫২ জনের একজন শিশু হাসনাইন। ভোলার চরফ্যাশনে তার বাড়ি। ওই অগ্নিকা-ের ঘটনায় নিহত সাতজন ভোলার চরফ্যাশনের। এ ঘটনায় উপজেলার আরও ৭ জন আহত হয়েছেন।

নাজমা বেগমের দুঃখের দিন আর ফুরোয় না। তৃতীয় সন্তানের জন্মের দেড় বছরের মাথায় স্বামী অন্য জায়গার সংসার পাতেন। নাজমার তিন ছেলের মধ্যে ইয়াসিন (১৭) সবার ছোট। রূপগঞ্জের একটি বেসরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র সে। হাসেম ফুড কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় ইয়াসিনের নিখোঁজ হওয়ার পর ইসমাইলের আর্তনাদ দেখে প্রতিবেশীরা কেঁদেছেন। নিখোঁজের পর ইসমাইল শোকে পাথর হয়ে গেছেন। গলায় আর শব্দ আসে না, না খেয়ে থেকে শরীরেও বল নেই। এর মধ্যে ভাইকে খুঁজতে গিয়ে পুলিশের মার খেয়েছেন তিনি। পা ও হাতে পুলিশের ছররা গুলি লেগেছে। নিখোঁজ ভাইয়ের সন্ধানে সম্ভাব্য সব হাসপাতালে খুঁজেছেন তিনি।

এমন অসংখ্য শিশু শ্রমিক ওই অগ্নিদগ্ধ কারখানায় কাজ করত। কেউ এসেছিল স্কুল বন্ধ, বাড়তি কিছু আয়ের আশায়। লকডাউনে দিশেহারা পরিবারকে সাহায্য করতেই অনেক শিক্ষার্থী পেটের ক্ষুধা নিরারণের আশায় এসেছিল ওই কারখানায় কাজ করতে। পেটের ক্ষুধা পেটেই রইল। আগুনে পুড়ে জীবন গড়ার স্বপ্ন ছাঁই হয়ে গেল। এর দায় কে নিবে? কারখানার মালিক না পরিবারের না দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সংস্থার? দায় কেউ নিক বা না নিক অকালেই ঝড়ে গেল আগামীর দেশ গড়ার/ পরিচালনার কাড়িগর অসংখ্য শিশুর প্রাণ।

বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরি হতো সেজান জুসের এ কারখানায়। প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক দিয়ে চলত তাদের কাজ। কর্মরত শিশু-কিশোর, শ্রমিক-জনতা পেটের আগুন জুড়ানোর জন্য মাত্র সপ্তাহখানেক আগে গত বৃহস্পতিবার রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন।

দুই মাস ধরে তাঁদের বেতন ও ওভারটাইমের টাকা পরিশোধ করছিল না মালিকপক্ষ। বাড়িভাড়া ও মুদিদোকানের বকেয়া পরিশোধ করতে না পেরে বাধ্য হয়ে তাঁরা রাস্তায় নেমেছিলেন। সপ্তাহ না ঘুরতেই তাঁরা শিকার হলেন কারখানার রহস্যময় আগুনের। মালিক বলেছেন, আগুন লাগতেই পারে। কী কঠিন পরিহাস!

গত ১ জুলাই বিক্ষোভের খবর পেয়ে কাঁচপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ ও ভুলতা ফাঁড়ি পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে’ এনেছিল। গলা উঁচু করে জানিয়ে গিয়েছিল, ‘মালিকপক্ষের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। গত ৫ জুলাই শ্রমিকদের দুই মাসের বকেয়া ওভারটাইমের টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। বাকিটা ঈদের আগে পরিশোধ করে দেওয়া হবে। কোম্পানির অ্যাডমিন ইনচার্জ ইঞ্জিনিয়ার সালাউদ্দিনও সংবাদমাধ্যমকে একই কথা বলেছিলেন। বলা বাহুল্য, কেউ কথা রাখেনি।

পেটের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে কারখানার আগুনের পুড়ে কয়লা হলেন তাঁরা। শুক্রবার সন্ধ্যায় এক উদ্ধারকর্মী কাঁদতে কাঁদতে জানান, চেনা যায় না কে নারী কে পুরুষ, কোনটা মাথা, কোনটা হাত। মৃতদেহগুলো আগুনে পুড়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে নারী, পুরুষ কিংবা পরিচয় কারও পক্ষে কোনো কিছুই চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।

বিক্ষুব্ধরা বলছেন, চারতলায় ‘দরজা বন্ধ’ না থাকলে এত মৃত্যু হতো না। পুলিশের কাঁদানে গ্যাস আর লাঠির বাড়ি খেয়েও শিশুকন্যার খোঁজে আসা হাতেম আলী ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস জানাল, পাঁচ-ছয়তলায় কোনো লাশ মেলেনি। সেটা শুনে ওরা স্তব্ধ, ‘এটা অসম্ভব’। নিচের সিঁড়ি আগুনে বন্ধ হওয়ায় সবাই ওপরে উঠে গিয়েছিল। ছাদের তালা খোলা না বন্ধ ছিল, জানা নেই। পাঁচ-ছয়তলায় অনেকে আটকা পড়ার কথা। তাঁদের লাশ কোথায় গেল?

একটা হাজিরা খাতা পড়ে ছিল, পৃষ্ঠাগুলো ছেঁড়া। তালা মারার অভিযোগ নিয়ে মালিকপক্ষ বিবিসিসহ সবাইকে বলেছিল, ‘এটি মিথ্যা কথা, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’ তাহলে সত্য কোনটা? তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ডিসি মহোদয় এবং ডিআইজির সঙ্গে কথা হয়েছে। এটা আমাদের মালিকপক্ষ দেখবে। এদের ক্ষতিপূরণ সম্পূর্ণ ম্যানেজমেন্ট দেবে।’

নাছোড়বান্দা সাংবাদিকরা জানতে চান, তালা দেওয়া না থাকলে এতগুলো বডি এক জায়গায় পাওয়া গেল কীভাবে? মালিকপক্ষের উত্তর, ‘যখন নিচতলায় আগুনটা ধরেছে, তখন সবাই আতঙ্কে ওপরে চলে গেছে।’ তাই বোকা লোকগুলো পুড়ে কয়লা হয়েছে একসঙ্গে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় এক উদ্ধারকর্মী কাঁদতে কাঁদতে জানান, চেনা যায় না কে নারী কে পুরুষ, কোনটা মাথা, কোনটা হাত। মৃতদেহগুলো আগুনে পুড়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে নারী, পুরুষ কিংবা পরিচয়—কারও পক্ষে কোনো কিছুই চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।

বিক্ষুব্ধরা বলছেন, চারতলায় ‘দরজা বন্ধ’ না থাকলে এত মৃত্যু হতো না। বিকেল পাঁচটায় আগুন লাগার পর অনেকেই মুঠোফোনে ফোন দিয়েছিলেন কাছের মানুষদের, কেউ মাকে, কেউ বাবাকে, স্ত্রীকে, স্বামীকে। জেনে গিয়েছিলেন, এটাই তাঁদের কেয়ামত, শেষ দিন। না হলে বাঁচার কথা ভুলে জীবনের ভুলত্রুটির জন্য শেষবারের মতো ক্ষমার আকুতি কেন জানাবেন? লাশ গণনা শেষ হওয়ার আগেই অনেক শ্রমিক আর মানবাধিকার সংগঠনের বিবৃতি পৌঁছে গেছে সংবাদপত্র আর টিভি চ্যানেলে।

এসব বিবৃতিতে সস্তা শিশুশ্রমের অব্যাহত অপব্যবহার নিয়ে কিছু বলা হয়নি। প্রকারান্তরে মেনে নেওয়া হয়েছে মৃতের সংখ্যা। তাজরীন, রানা কি হা–মীম অথবা নরসিংদীর তোয়ালে কারখানা কিংবা গাজীপুরের চান্দনায় গরিব অ্যান্ড গরিব সোয়েটার কারখানা—কোথাও কি নিখোঁজের সব হিসাব কোনো দিন পাওয়া যাবে? অপেক্ষমাণ অভিভাবক আর জানে বেঁচে যাওয়া সহকর্মীদের কাছ থেকে যেসব নাবালক-নাবালিকার নাম পাওয়া গেছে, সেটাই এখন একমাত্র তালিকা। এদিকে সরকারের শ্রমকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আগুনে পুড়া কারখানা পরিদর্শনে এসে বলেছেন, শিশু শ্রমিক বললেই তো হবে না। প্রমাণ দিতে হবে। কত শিশু অকালে মরে আর কত প্রমান দিবে? কেউ নেই , দেখার কেউ নেই।

এসব সুরক্ষিত গারদ নামের কারখানায় চৌদ্দগুষ্টির নাম-ঠিকানা না লিখে কি ঢোকা সম্ভব? যাঁরা লাইসেন্স দেন, নবায়ন করেন, সেই সরকারি প্রতিষ্ঠান কলকারখানা পরিদর্শকের অফিস বলছে, ‘আমাদেরই ঢুকতে দেয়নি বারবার অনুরোধ করার পরও।’ শিল্প কালকানার মালিকরা খেটে খাওয়া মানুষের কর্মসংস্থান করেন বলে কি তারা বিচার বা আইনের উর্দ্ধে? তারা কি মানুষ মারার কারখানা স্থাপন করেছেন? তারা কি মানবতার উর্দ্ধে?/ কে দিবে এসব প্রশ্নের উত্তর নাকি কারখানার ইট পাথওে ধাক্কা খেয়ে বার বার ফিরে আসবে ক্ষুধার্থ মানুষগুলোর কানেই??????? ঊন্ধ হোক শিশু শ্রম। বন্ধ হোক মানুষ মারার কারখানার আগুন।

আপনি আরও পড়তে পারেন