বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেল হাওরের ১৮৫ হেক্টর জমির ধান

বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেল হাওরের ১৮৫ হেক্টর জমির ধান

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার চন্দ্র সোনার থাল এবং শাল্লার পুটিয়ার হাওরে বাঁধ ভেঙে হাজারো কৃষকের ফসল ডুবে গেছে। মঙ্গলবার (০৫ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে এই দুটি বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রবল বেগে পানি ঢুকে তলিয়ে যায় হাওর।

বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ও সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ঘটনাস্থলের পাশপাশি রাজাপুর বাজারে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুব্ধ কৃষকরা বাঁধের কাজে অনিয়ম হওয়ায় তাদের সর্বনাশ হয়েছে বলে দাবি করেন।

গতকাল সোমবার রাত থেকে এই হাওরের ডুবাইল অংশের বরুণ কাইচ্ছা বাঁধে ধস শুরু হয় এবং বাঁধের নিচ দিয়ে পানি ঢুকতে থাকে। স্থানীয় কৃষকরা প্রাণপণ চেষ্টা করে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত বাঁধ আটকে রাখেন।

হাওরের পার্শ্ববর্তী জৈনপুর গ্রামের কৃষক কাশেম মিয়া জানান, শত শত কৃষক ২০ ঘণ্টা ধরে এই বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করেন। তবে কংস নদের পানি কূল উপচে হাওরে ঢুকে ফসল তলিয়ে যায়।

মঙ্গলবার দুপুরে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. মোশাররফ হোসেন, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন, সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম এই বাঁধ পরিদর্শন করেন এবং বাঁধ রক্ষায় সব সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

একই গ্রামের কৃষক কাঞ্চন ও শাহীন আলম নিজেদের ক্ষতির কথা জানিয়ে বলেন, এই ক্ষতি পোষানোর ক্ষমতা নেই তাদের।

কাঞ্চন বলেন, দুই লাখ টাকা ঋণ এনে জমি চাষ করেছিলাম। এখন ঋণ পরিশোধ করব কীভাবে? পরিবারের অবস্থা কী হবে?

কৃষক শাহীন আলম বলেন, আমার ৫ একর জমির সবই পানিতে ডুবে গেছে।

কৃষকরা জানান, এই হাওরের বরুণ কাইচ্ছা বাঁধ দুর্বল হওয়ার কথা আগে থেকেই বলে আসছিলেন তারা।

সুখাইড় রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রুবেল আহমদ বলেন,  এই বাঁধ ভাঙায় নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ, বারহাট্টার কিছু অংশের ফসল ডুবে যাবে। বাঁধ ভাঙায় কমপক্ষে ২০০০ হেক্টর ফসল ডুববে।

তিনি বলেন, ১০-১২ দিন আগে এই বাঁধের কাজ হয়েছে। বাঁধের কাজ করেছে দয়ালপুর গুচ্ছ গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম। তিনি কৃষক নন, তাকে কীভাবে কাজ দেওয়া হলো আমরা জানি না। অসময়ে এই বাঁধ হওয়ায় পানির প্রথম ধাক্কায়ই ভেঙে গেছে।

স্থানীয় সুখাইড় রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোকারম হোসেন বলেন, বাঁধের যে অংশে ফাটল ধরেছিল, সেই অংশ মেরামত করতে করতে বিকেলে অন্য অংশ ভেঙে পানি ঢুকতে শুরু করে।

তিনি বলেন, বাঁধের কাজ কারা করেছে আমি জানি না, আমি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার আগেই কাজ দেওয়া হয়েছে।

ধর্মপাশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোনতাসির হাসান বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে কারা ছিল এ বিষয়ে কাগজ না দেখে বলা যাবে না। বাঁধের কাজ ঠিকঠাক ভাবেই হয়েছিল।

সন্ধ্যায় বাঁধের পাশের সুখাইড় রাজাপুর বাজারে বিভাগীয় কমিশনার মোশাররফ হোসেন ও জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন গেলে অর্ধশতাধিক কৃষক ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, বাঁধের কাজ অসময়ে হয়েছে। দুর্বল কাজ হয়েছে। নীতিমালা অমান্য করে কৃষক নয় এমন ব্যক্তিকে বাঁধের কাজ দেওয়ায় আমাদের সর্বনাশ হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, ২০১৭ সালেও বাঁধের কাজ না হওয়ায় প্রথম ধাক্কায় সুনামগঞ্জের চন্দ্র সোনার তাল হাওর ডুবেছিল।

এদিকে জেলার শাল্লার পুটিয়ার হাওরের বাঁধ ভেঙে প্রায় ২০০ একর ফসল তলিয়ে গেছে। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে এই বাঁধ ভেঙে যায়।

শাল্লা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু জানান, দাড়াইন নদীর পানি কূল উপচে মুক্তারপুর সেতুর পাশের বাঁধ ভেঙে হাওরে প্রবেশ করছে। এই বাঁধটিও সকাল থেকে রক্ষার চেষ্টা করছিলেন কৃষকরা। কৃষকদের ২০০ একর জমি পানিতে ডুবেছে।

জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমরা সকাল থেকে জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, মধ্যনগর উপজেলার বিভিন্ন বাঁধ, ক্লোজার পরিদর্শন করেছি। ধর্মপাশা থেকে যখন আমরা তাহিরপুরের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন খবর পেলাম ডুবাইল বাঁধটি লিকেজ হয়েছে। আমরা এখানে ফিরে আসতে আসতে বিশাল অংশ ভেঙে যায়।

তিনি বলেন, ডুবাইল হাওরে কৃষকরা ২০০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। এর মধ্যে আজ ১৫ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। এখন ১৮৫ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে যাচ্ছে। ডুবাইল হাওরের পার্শ্ববর্তী হাওরের নাম চন্দ্রসোনার থাল হাওর। সেই হাওরে ২ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে। সেই ধান পাকতে আরও সময় লাগবে।

জেলা প্রশাসক বলেন, মাইকে আমরা গ্রামবাসীকে আহ্বান জানিয়েছি। বাঁধ রক্ষা করার জন্য গ্রামবাসী কোদাল নিয়ে এসেছেন। এলজিইডির সাবমার্সিবল সড়কটি মাটি দিয়ে উঁচু করা হবে এবং কালভার্টের নিচে মাটি দিয়ে আটকে দেওয়া হবে। যাতে আমরা জমির ধান রক্ষা করতে পারি।

তিনি বলেন, আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইতোমধ্যে এখানে অনেক মানুষ কোদাল নিয়ে জড়ো হয়েছেন। রাতেই মাটি কাটা শুরু হবে। আমরা আশা করি রাতের মধ্যে এলজিইডির সাবমার্সিবল রাস্তাটি উঁচু করে ফেলতে পারব। আমরা এটি করতে পারলে চন্দ্রসোনার থাল হাওরের ২ হাজার ৯০০ হেক্টর জমির ধান রক্ষা করতে পারব।

 

আপনি আরও পড়তে পারেন