বাংলাদেশে সাপের বিষ আসে কোথা থেকে, যায় কোথায়

বাংলাদেশে সাপের বিষ আসে কোথা থেকে, যায় কোথায়

ঢাকার দক্ষিণখান এলাকা থেকে কাঁচের জারে রক্ষিত অবস্থায় প্রায় নয় কেজি ওজনের সাপের বিষসহ কয়েকজনকে র‍্যাব আটক করেছে। যদিও একজন গবেষক সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন যে এগুলো সাপের বিষ কিনা তা গুরুত্ব দিয়ে পরীক্ষা করা উচিত।

পুলিশের এলিট ফোর্স র‍্যাব জানিয়েছে ঢাকা থেকে উদ্ধার করা এসব সাপের বিষের আনুমানিক মূল্য পঁচাত্তর কোটি টাকা এবং তাদের ধারণা বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে এগুলো পাচারের জন্য আনা হয়ে থাকতে পারে।

‘আটককৃতদের সাথে কাঁচের জারে রক্ষিত অবস্থায় আট দশমিক ৯৬ কেজি সাপের বিষ পাওয়া যায়। এছাড়া তাদের কাছ থেকে সাপের বিষ সংক্রান্ত সিডি ও সাপের বিষ নিয়ে ম্যানুয়াল বই উদ্ধার করা হয়েছে,’ র‍্যাব জানিয়েছে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।

র‍্যাবের সহকারী পরিচালক মোঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলছেন তারা যখন সাপের বিষের জার উদ্ধার করেছেন তার ওপরে লেখা ছিলো ‘মেড ইন ফ্রান্স’।

র‍্যাবের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছে, বেশি মুনাফার লোভে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাপের বিষ সংগ্রহ করে চোরাচালান করে আসছিল তারা।

‘গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা একটি সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক সাপের বিষ চোরাচালান চক্রের সক্রিয় সদস্য। এছাড়াও আটককৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে,’ বলছে র‍্যাব।

এর আগে গত পঁচিশে নভেম্বর গাজীপুর থেকে প্রায় নয় কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষসহ কয়েকজনকে আটক করেছিলো পুলিশের আরেকটি সংস্থা সিআইডি। পরে ২৬শে নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মোঃ রেজাউল হায়দার এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন।

তারও আগে চলতি বছরেই জুন মাসে ফেনীতে দুই পাউন্ড সাপের বিষসহ এক ব্যক্তিকে আটক করেছিলো র‍্যাব।

এর আগেও কয়েক বছর ধরে সাপের বিষ উদ্ধারের খবর নিয়মিতই পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৭ সালে ঢাকা থেকেই ১২ পাউন্ড সাপের বিষ উদ্ধার করেছিল পুলিশ তখন যার মূল্য ছিলো প্রায় ৬৮ কোটি টাকা। তার আগের বছর চুয়াডাঙ্গা থেকে বারো কোটি টাকা মূল্যের বিষ উদ্ধার করা হয়েছিলো।

অন্যদিকে, ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে জলপাইগুড়িতে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষ উদ্ধারের ঘটনা বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো। তখন সেখানকার কর্মকর্তারা স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন এগুলো বাংলাদেশ থেকে সেখানে গিয়েছে।

কোথা থেকে আসে বিষ, যায়ই বা কোথায়

র‍্যাবের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলছেন পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষ হলেই এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।

‘তবে আমরা যেগুলো উদ্ধার করেছি সেগুলোর প্যাকেটের ধরন দেখে মনে হচ্ছে বাইরে থেকে এসেছে। আর জারগুলোতে লেখা ছিলো মেড ইন ফ্রান্স।’

এর আগে গাজীপুরে বিষ উদ্ধারের পর সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মোঃ রেজাউল হায়দার বলেছিলেন তারা যে বিষ উদ্ধার করেছিলেন তার জারগুলোতেও মেড ইন ফ্রান্স লেখা ছিলো।

তিনি তখন বলেছিলেন পাচারকারীরা সাপের বিষ পাচারের রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে আসছে।

শেখ মোঃ রেজাউল হায়দার অবশ্য বলেছিলেন যে বাংলাদেশ থেকে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিষ পাচার হয়। আবার কখনো সেসব দেশ থেকে এনেও অন্য দেশে নেয়া হয়।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের আইনে সাপের বিষের লেনদেন বা ক্রয় বিক্রয় এবং পাচার দণ্ডনীয় অপরাধ। তারপরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের ধারণা বছরে অন্তত একশ কোটি টাকা মূল্যের বিষ পাচার হয় বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে।

ফেনী, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, যশোর, কুমিল্লাসহ কয়েকটি এলাকায় একাধিক চক্র গড়ে ওঠেছে যারা সাপের বিষ সংগ্রহ ও চোরাচালানের সাথে জড়িত বলে পুলিশের ধারণা।

তবে একমত নন সাপ গবেষক

সাপ ও সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইনজিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজির অধ্যাপক মোঃ আবু রেজা।

রেজা বলছেন বিষ কোথা থেকে আসে আর কোথায় যায় এ প্রশ্ন তোলার আগে পরীক্ষা করে দেখতে হবে যা উদ্ধার করা হয়েছে তা আসলে সাপের বিষ কি-না।

‘কয়েক বছর আগে এমন উদ্ধার করা সাপের বিষের নমুনা পরীক্ষার সুযোগ আমার হয়েছিলো। সেগুলো বিষ ছিলো না। তবে সেগুলো কি তা আমিও নিশ্চিত নই। মনে হয়েছিলো মাদক জাতীয় কিছু হতে পারে। স্বল্প মাত্রায় সাপের বিষ দিয়ে মাদকের প্রচলন কোথাও কোথাও রয়েছে। তবে যা উদ্ধার হয়েছে তা নিয়ে যথাযথ পরীক্ষা হওয়া দরকার,’ বলছিলেন তিনি।

এছাড়া কোথাও কোথাও সাপের বিষ ব্যবহার করে এক ধরণের যৌন উত্তেজক সামগ্রী তৈরি হয় যা অনেক দেশে পাচারও হয়, এগুলো তেমন কিছু কি না তাও পরীক্ষা করা দরকার বলে মনে করেন রেজা।

রেজা প্রশ্ন তোলেন যে যদি সাপের বিষ চোরাচালান বা পাচার হবে তাহলে যেগুলো উদ্ধার করা হয়েছে তার জারে এন্টি স্নেক ভেনম শব্দগুলো লেখা কেন।

ঔষধে ব্যবহার হয়?

বাংলাদেশের ঔষধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান ঔষধ তৈরিতে সাপের বিষ ব্যবহার করে না। তবে ২০১৭ সাল থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরির লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়।

পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে যুক্ত রয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ এবং জার্মানির গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা।

প্রকল্পের জরিপের কাজ অর্থাৎ দেশি সাপের প্রায় সব ধরনের প্রজাতির ওপর জরিপ চালানো শেষ হয়েছে।

এছাড়া সবচেয়ে বিষধর সাপের প্রজাতি সংগ্রহ এবং সেগুলোর লালনপালনের জন্য লোকজনকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজও চলছে।

বিষধর সাপের জীবনযাপন ও দংশন প্রক্রিয়া সম্পর্কে পুরোপুরি জানার পরই অ্যান্টিভেনম তৈরির কাজটি সফল হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

আপনি আরও পড়তে পারেন