বয়ফ্রেন্ড না ব্যভিচার

বয়ফ্রেন্ড না ব্যভিচার

 

বয়ফ্রেন্ড কথাটির সাথে আমাদের চেতনা ও সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। ইংরেজরা এ দেশে আসার পর তাদের নিজেদের মধ্যে বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড কথাটার প্রচলন ঘটে। তার আগেও মানবসমাজে প্রেম ছিল। প্রেমের সম্পর্কের কারণে অনেক রাজা সিংহাসন ত্যাগ করেছেন। অনেক রাজকুমারী রাজপরিবারের সাথে সম্পর্ক ছেদ করেছেন। পরে ইউরোপ আমেরিকার তরুণ-তরুণীরা অবাধ যৌনাচারের কারণে বিয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। দু’জন নর-নারী বিয়ে না করেও একত্রে স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করতে শুরু করে। তাদের সমাজ জনগণের সে চাহিদা মেনে নেয়। কিন্তু বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডদের জন্য একই ধরনের আইন প্রণয়ন করে। অর্থাৎ কিছুকাল একত্রে বসবাস করার পর তারা যদি পৃথক হয়ে যায় তবে স্বামী-স্ত্রীর সম্পদ যেভাবে বণ্টন হয়, একই ভাবে বয়ফ্রেন্ড ও গার্লফ্রেন্ডের মধ্যে সম্পদের বণ্টন হয়। এটি প্রধানত নারী সুরক্ষার জন্য। লিভ টুগেদার পরিবারে সন্তানের জন্ম হয় এবং সে সন্তান কত বছর বয়সে কার কাছে থাকবে তারও সুনির্দিষ্ট আইন আছে।

মানবসমাজে পরকীয়ার ইতিহাস নতুন নয়, কিংবা লিভটুগেদার পুরনো হয়ে যায়নি। এই যেমন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডেন বিয়ে করেননি। তিনি তার এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে লিভটুগেদার করতেন। তাদের ঘরে একটি কন্যাসন্তানও রয়েছে। জেসিন্ডা বিয়ে করার সময় করতে পারছেন না। তবে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি তার বয়ফ্রেন্ডকে শিগগিরই বিয়ে করবেন। সেখানে সমাজ এতটাই উদার যে, এই পরিস্থিতিতেও জেসিন্ডার প্রধানমন্ত্রী হতে কোনো বাধা আসেনি। কেউ প্রশ্নও তোলেনি। ব্রিটিশ রাজা অষ্টম জর্জ প্রেমিকার জন্য সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন।

সম্প্রতি জাপানের রাজকুমারী তার পছন্দের প্রেমিককে বিয়ে করার জন্য নিজের রাজকীয় সব সুবিধা বর্জন করেছেন। ব্রিটিশ রাজকুমার এন্ড্রু সেগান মারকেলকে বিয়ে করার জন্য রাজপরিবারের সাথে সব সম্পর্ক ত্যাগ করে এখন পরবাসী হয়েছেন। তিনি সাধারণ মানুষের জীবনযাপন করতে চান। ইতিহাস ঘাঁটলে এ ধরনের ভূরি ভূরি নজির পাওয়া যাবে।

তবে প্রেম মনুষ্য জন্মের পর থেকেই আছে। সাধারণভাবে একজন অবিবাহিত ছেলে বা মেয়ে আরেকজন ছেলে বা মেয়ের প্রেমে পড়লে তাকে খুব খারাপ চোখে দেখা হয় না। এ নিয়ে কানাঘুষা হয়। এর সাথে ও ঠাট্টা করে। তারপর একসময় হয়তো বিয়েই করে। তারপর সে সম্পর্ক ভেঙে যায়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়েবিচ্ছেদের ঘটনাও নতুন নয়। বিয়েবিচ্ছেদের পর তারা হয়তো আবার বিয়ে করেন। কেউ কেউ আর বিয়েই করেন না। এটা আমাদের দেশের স্বীকৃত সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ।

অবাধ যৌনাচারের দেশে বিবাহিত কোনো নারী বা পুরুষ যদি একই সাথে অন্য কারো প্রেমে পড়ে তবে তাকে ভালো চোখে দেখা হয় না। সেখানে কোনো মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিলে সে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, তুমি কি বিবাহিত? কিংবা, তোমার কি কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে? উত্তর হ্যাঁ সূচক হলে সেখানে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় না।

কিন্তু ক্রমে ক্রমে ইউরোপ আমেরিকার সে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ডের ঢেউ পৃথিবীর রক্ষণশীল সমাজে এসেও লেগেছে। এখন বাংলাদেশে ছেলেমেয়েরা স্পষ্ট করে বলতে পারে, সে আমার বয়ফ্রেন্ড, সে আমার গার্লফ্রেন্ড। অভিভাবকরা এ ধরনের মনোভাব মেনে নিতে চান না। ফলে নানা অঘটন ঘটে। এর ওপর নতুন আপদ এসে জুটেছে লিভটুগেদার। অর্থাৎ বিয়ে না করেও তরুণ-তরুণীরা একই ছাদের নিচে একসাথে বসবাস করতে শুরু করেছে। এটি গোপনেই ঘটে। নগরের বাড়িওয়ালারা অবিবাহিত দম্পতিকে বাসা ভাড়া দিতে চান না। তখন বন্ধু তরুণ-তরুণীরা একত্র হয়ে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাসা ভাড়া নেয়।

তাদের এসব বাসায় বেশি আসবাবপত্র থাকে না। তারা যদি ধরা পড়ে যান তবে দ্রুত বাসা বদল করে ফেলেন। এ সম্পর্কে রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রধান কারণ আবাসিক সঙ্কট। নারী-পুরুষরা এখন ঘরের বাইরে শুধু নয়, নিজ শহরের বাইরে দূর-দূরান্তের শহরেও চাকরি করেন। নারী একা হলেও বাসা ভাড়া পান না। এ সমস্যা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তারাও দূর-দূরান্ত থেকে শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করতে আসেন। এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের জন্য যথেষ্ট আবাসিক ব্যবস্থা নেই। ফলে তারা একত্র হয়ে একসাথে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাসা ভাড়া নেন কিংবা মেসে থাকেন। যাদের সঙ্গতি আছে তারা বাসা ভাড়া নিয়েই থাকেন। বহু ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে। এদের কারো আত্মীয়স্বজন এলে বেরিয়ে যায় বা লুকিয়ে পড়ে। এ ধরনের লুকোচুরির ভেতর দিয়েই গড়ে ওঠে লিভটুগেদার কিংবা পরকীয়া। বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে এগুলো সাধারণত দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়। কিন্তু সমাজে এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। সম্প্রতি এ রকম কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।

সম্প্রতি পান্থপথের একটি আবাসিক হোটেলে নারী চিকিৎসক জান্নাতুল নাঈম সিদ্দিকাকে গলা কেটে হত্যা করেছে তার স্বামী রেজায়ুল করীম রেজা। জান্নাতুল এমবিবিএস পাস করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ইন্টার্ন করছিলেন। দু’জন বিয়ে করলেও একসাথে সংসার হয়নি। ঘটনার সময় রেজায়ুল তাকে নিয়ে হোটেলে উঠেছিলেন। রেজায়ুলের একাধিক নারীর সাথে সম্পর্ক নিয়ে দু’জনের মধ্যে বাগি¦তণ্ডা হয়। তার একপর্যায়ে রেজা জান্নাতুলকে হত্যা করেন। হত্যা করে তিনি সম্ভবত লোডশেডিংয়ের অপেক্ষা করেছেন।

লোডশেডিং শুরু হলে দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে যান, যাতে হোটেলের সিসি টিভি ক্যামেরায় তার চলে যাওয়ার দৃশ্য ধরা না পড়ে। তাদের মধ্যে বিয়ে ও বিয়ে পূর্ববর্তী প্রেমের সম্পর্ক ছিল অনেক দিনের। জান্নাতুলের পরিবার রেজার সাথে বিয়ে দিতে রাজি ছিল না। উভয়ে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হলেও রেজায়ুল অন্যান্য নারীর সাথে সম্পর্ক করে চলেছিলেন। মূলত স্বামীর অনৈতিক সম্পর্কের জের ধরে বেঘোরে প্রাণ গেল জান্নাতুলের। আর ফাঁসি না হলেও সারা জীবন জেলে কাটাতে হবে রেজায়ুল করীমকে। ধ্বংস হয়ে গেল দু’টি পরিবার, ভেঙে গেল একটি স্বপ্ন। এরকম ঘটনা কিন্তু সমাজে অহরহ ঘটছে। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বহু নারী ধর্ষণ কিংবা হত্যার শিকার হয়েছেন। প্রতিদিন হচ্ছেন।

সমাজের উপরের স্তর থেকে শুরু করে একেবারে নিম্নস্তর পর্যন্ত নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে ক্রমেই পরকীয়ার প্রকোপ বাড়ছে। সেটি রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রদূত কাজী আনারকলি পরকীয়ায় ধরা খেয়েছেন। প্রথমে তার পোস্টিং হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের লসএঞ্জেলেসে। সেখানে তিনি তার বয়ফ্রেন্ডকে গৃহকর্মী দেখিয়ে সাথে নিয়ে যান। মার্কিন সরকার প্রথমে এই (গৃহকর্মীকে) ভিসা দিতে অস্বীকার করে। আনারকলির কী পাওয়ার? তার গৃহকর্মীর ভিসার জন্য গোটা মন্ত্রণালয় তদবির করেন। কিন্তু আনারকলির বহুগামিতার জন্য সেই বয়ফ্রেন্ড নিরুদ্দেশ হয়ে যান।

সে জন্য আনারকলিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে এনে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা উচিত ছিল; কিন্তু তা তো হয়ইনি বরং তাকে লসএঞ্জেলেস থেকে সরাসরি জার্কাতায় উপরাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সেখানে তিনি তার অর্ধেক বয়সী এক নাইজেরিয়ানকে বয়ফ্রেন্ড হিসেবে জোগাড় করেন এবং তার সাথে থাকতে থাকেন। গোয়েন্দা সূত্রে ইন্দোনেশিয়া সরকার জানতে পারে যে, আনারকলির বাসায় মারিজুয়ানা আছে ও তা নিয়মিত সেবন করা হয়। মাদকদ্রব্য আইনে আনারকলি গ্রেফতারই হতেন, কিন্তু ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশের দূতাবাসের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তাকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এখন তদন্ত চলছে। আসলে আনারকলিকে ‘গৃহকর্মী’ ইস্যুতে যদি তখনই আটকে দেয়া যেত তাহলে যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ণ থাকত।

এমনি আরেকটি খবর ছাপা হয়েছে, নাটোরে এক স্বনামধন্য কলেজের শিক্ষিকা, এক চিকিৎসকের বিছানায় যাচ্ছেন নিয়মিত। কলেজশিক্ষিকা অস্বীকার করেননি যে এরকম সম্পর্ক তাদের ছিল না। বরং তিনি বলেছেন, দু’জনের সম্মতিতেই তাদের দৈহিক সম্পর্ক হয়েছে। সে মিলনের ছবি পত্রপত্রিকায় ভাইরাল হয়েছে। ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বলেছেন, এরকম একজন নারী তাদের সহকর্মী, এটা ভাবতেও তারা লজ্জাবোধ করছেন। ওই নারী নাকি ওই ভিডিওটি দেখিয়ে চিকিৎসককে ব্লাকমেইল করেন।

ঘটনাকে আমরা যেভাবেই দেখি না কেন, সমাজ থেকে নৈতিক অবক্ষয় দূর করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। আসলে মেধা নয়, দলীয় বিবেচনায় ঢালাওভাবে নিয়োগের ফলে সমাজের ভেতরে এ অবক্ষয় তৈরি হয়েছে। যারা এ ধরনের কাজ করছেন তারা জানেন যে, আমি যেহেতু সরকারি দলের ক্যাডার ফলে আমি যা-ই করি না কেন, কেউ আমার টিকিটিরও দেখা পাবে না। আর তাই যার যা খুশি করে যাচ্ছেন।

সরকার গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায় থেকে যে নৈতিক শিক্ষা দেয়ার কথা কিংবা পাঠ্যপুস্তকে নৈতিকতার বিকাশে যেসব বিষয় পড়ার কথা সেগুলো তুলে দেয়া হয়েছে। এখন আস্তে আস্তে গোল্লায় যাচ্ছে সমাজ ও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

 

আপনি আরও পড়তে পারেন