আনিসুল হক ১৯৫২ সালের ২৭ অক্টোবর নোয়াখালী জেলার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর শৈশবের বেশ কিছু সময় কাটিয়েছেন নানার বাড়ি ফেনীতে। বাবা ছিলেন সরকারী চাকুরীজীবী। ৪ সন্তান এবং স্ত্রীকে নিয়ে ছিল উনার সংসার। নিজের ছোট সন্তানের ক্যাডেট কলেজের বেতন দিতে রীতিমত হিমশিম খেতন। এমন সংগ্রামের সংসারেই আনিসুল হকের বেড়ে উঠা। স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়েছেন মফস্বল থেকে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকোনোমিক্সে স্নাতক করেন।
আনিসুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর পর বেশ কয় বছর বেকার ছিলেন। চাকরি খুঁজতেন পাশাপাশি বিটিভিতে কাজ করতেন। বিটিভিতে টুকটাক কাজ করার সুবাধে ২৫/২৬ বছর বয়সেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু জীবনের অনিশ্চয়তা দেখে তাঁর বাবা তাঁকে ডেকে বললেন, আমি আমার পেনশনের টাকা থেকে কিছু টাকা তোমাকে দেবো। তুমি ঠিক করো তুমি কি করবে? বাবাকে জানালেন, পাট এর ব্যবসা করতে চান। বাবা পাটের ব্যবসার জন্য তাঁকে ষোল হাজার টাকা দিলেন।
আনিসুল হক হিসাব করে দেখলেন এই টাকা দিয়ে দুই ট্রাক পাট কিনে সাপ্লাই দিতে পারলে বেশ ভাল লাভ করা যাবে। সেই হিসেব কষে পাট কিনতে চলে গেলেন টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে। পাট কেনার সময় স্থানীয় একজন বলছিলো, স্যার ট্রাক কিন্তু চুরি হয়। এই শুনে আনিসুল হক ভাবলেন, বাবার সারা জীবনের পেনশনের টাকা দিয়ে পাট কিনছেন। পাটের ট্রাক চুরি হলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই তিনি উঠে বসলেন প্রথম ট্রাকে। রাত ১১টায় ট্রাক ছাড়লো। তিনি প্রথম ট্রাকের চালকের পাশে গিয়ে বসলেন। পিছনের ট্রাক সামনের ট্রাককে ফলো করে এগুতে থাকলো। রাত দুইটার দিকে মাঝপথে হটাৎ ট্রাক থামিয়ে ড্রাইভার জানতে চাইলেন, স্যার পিশাব করবেন? আনিসুল হক কিছু বুঝে উঠার আগেই দরজা খুলে তাঁকে লাথি মেরে বাহিরে ফেলে দেয় ট্রাক চালক। দুই ট্রাক পাট সেদিন রাতেই চুরি হয়ে যায়।
জীবনের প্রথম ব্যবসা শুরুর আগেই ক্ষতির সম্মুখীন হলেন। এই ঘটনার পর বাবার কাছে গেলেন বাবা বললেন , তুমি ভাল করে চিন্তা করে দেখো তুমি কী করবে? আমার আরো কিছু টাকা আছে। আমি তোমাকে দিবো। এরপর ৪ বন্ধু মিলে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এক বন্ধু সদ্য বিয়ে করা বউয়ের গহনা বিক্রি করলেন, আরেকজন এক বছরের চাকরীর জমানো টাকা দিলেন, অন্যজন বাবার জমি বিক্রির টাকা আনলেন আর আনিসুল হক পেলেন বাবার কাছ থেকে ৮৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ৪ বন্ধু ১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা জোগাড় করলেন। এরপর শুরু করলেন তাঁদের সংগ্রামের জীবন। ১৮০ ফুটের একটি রুমে ৩ বছর বসে ব্যবসা চালিয়েছেন। আর এখন তিন বন্ধু মিলে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিকের কাজ দিয়েছেন। আনিসুল হক বিশ্বাস করতেন , স্বপ্ন মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যায়। তাই তিনি স্বপ্ন দেখতেন এবং স্বপ্নের বাস্তবায়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। সেই পরিশ্রম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁকে সফল করে তুলেছে।
আনিসুল হক মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, একটা মানুষের জীবনে মায়ের দোয়া এবং ছায়া অনেক বড় শক্তি। সব সময় মায়ের দোয়া নিয়েই পথ চলতেন। প্রায় শবে বরাতের রাতে মা’য়ের পায়ের নিচে শুয়ে আনিসুল হক মা কে বলতেন, মা তুমি আমার গায়ের উপর একটা পা রাখো আর আমাকে একটা ফুঁ দিয়ে দাও। মা তাঁর পাগল ছেলের আবদার রাখতেন। আনিসুল হকের মা আর ৮/১০ টা মায়ের মতো খুব শিক্ষিত ছিলেন না। তারপরও আনিসুল হক প্রতিটি পদক্ষেপে মায়ের দোয়া নিতেন। মা এর মতামত নিয়ে পথ চলতেন।
স্কুল লাইফে একবার ফাইনাল পরীক্ষার আগের রাতে তাঁর ১০৪ ডিগ্রি জ্বর আসলো। তিনি মা’কে গিয়ে বলছেন, আমি পরীক্ষা দিতে পারবো না। আমার চোখ ঠিকমতো খুলতে পারছি না। মা বললো – বাবা, এই পরীক্ষা না দিলে তো তুমি এক বছর পিছিয়ে পড়বে। এরপর মা দোয়া দুরুদ পড়ে আনিসুল হকের পুরো শরীরে ফুঁ দিয়ে সাথে করে নিয়ে গেলেন পরীক্ষা দিতে। ৩ ঘণ্টার পরীক্ষা। উনি ২ ঘন্টা পরীক্ষা দিয়েই বের হয়ে আসলেন। মা বাহিরেই অপেক্ষায় ছিলেন। বের হয়ে আসার পর জানতে চাইলেন, সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছো ? উনি জানালেন, ৩৪ এর উত্তর দিয়েছি। মা জানতে চাইলেন, পাশ কত তে? তিনি বললেন, ৩৩ পেলে পাশ। এরপর মা বাড়ি গিয়ে নফল নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে বিভিন্ন দোয়া দুরুদ পড়ে আনিসুল হকের সারা শরীরে ফুঁ দিয়ে দিলেন। কিছুদিন পর পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। আনিসুল হক পরীক্ষায় ৩৪ এর উত্তর দিয়ে ঠিক ৩৪ই পেয়েছেন। ঐ সময়ে পরীক্ষায় ৩৪ এর উত্তর দিয়ে ৩৪ পাওয়া কেউ কল্পনাও করতে পারতো না। আনিসুল হক ঠিকই বুঝেছিলেন এটা মা এর দোয়ার বরকতে হয়েছে।
মা’কে নিয়ে উনার আরো একটি গল্প শেয়ার করছি। যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানালেন যে, তিনি তাঁকে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদের জন্য মনোনয়ন দিতে চান। তিনি তখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন । বাবার কাছে গেলেন, বাবা বললেন তোমার মায়ের কবরের পাশে যাও। তোমার মা কবরে থেকে তোমাকে ফুঁ দিয়ে দিবেন। উনি তাই করেছিলেন। মা বেঁচে নেই তারপরেও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এখনো মায়ের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ান।
আনিসুল হক জীবনের সব ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করেছেন। বিটিভির উপস্থাপক থেকে হয়েছেন মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান। ২০০৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিজিএমইএর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ২০০৮ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা উত্তরের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সাধারণ এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে তাঁর আজকের আনিসুল হক হয়ে উঠার পিছনে ছিলো মা-বাবার দোয়া এবং অক্লান্ত পরিশ্রম।