মনোনয়ন উৎসব | ৩০৫৬ মনোনয়নপত্র দাখিল

মনোনয়ন উৎসব | ৩০৫৬ মনোনয়নপত্র দাখিল

বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া অনেকটা উৎসবমুখর পরিবেশে সারা দেশে জাতীয় নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন প্রার্থীরা। শেষদিনে গতকাল বেশির ভাগ প্রার্থী নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন। ৩০০ আসনে বিভিন্ন দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে তিন হাজার ৫৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বলে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে। কয়েকটি আসনে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছেন।

রংপুর- আসনে জামায়াতের প্রার্থীর মনোনয়নপত্র রিটার্নিং কর্মকর্তা জমা নেননি বলে অভিযোগ করেছেন তার সমর্থকরা। এদিকে ঢাকার একটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস। ঢাকার রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে অবস্থান করে কাগজপত্র প্রস্তুত করার একপর্যায়ে নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার কথা বলে তার মনোনয়নপত্র জমা নেয়া হয়নি।

দেরিতে যাওয়ার কারণে আরও তিন স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি।

এদিকে মনোনয়নপত্র জমা দেয়াকে কেন্দ্র করে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুরসহ কয়েকটি স্থানে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ঢাকা মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে বাসার ফেরার পথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন ঢাকা-৭ আসনের বিএনপি’র প্রার্থী মোশাররফ হোসেন খোকন।

এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সারা দেশে ৩০০ আসনে ৩ হাজার ৫৬ জন মনোনয়ন দাখিল করেছেন। গতকাল রাতে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। সচিব বলেন, রংপুর বিভাগে ৩৬১ জন, রাজশাহী বিভাগে ৩৫৩ জন, খুলনা বিভাগে ৩৫১ জন, বরিশাল বিভাগে ১৮২ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৩৬ জন, ঢাকা বিভাগে ৭০৮ জন, সিলেট বিভাগে ১৭৭ এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ৬৮৮টি মনোনয়ন দাখিল করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন পড়েছে ঢাকা-৮ আসনে ২২টি।

মাগুরা-২ আসনে সর্বনিম্ন ৪ জন মনোনয়ন দাখিল করেছেন। সচিব বলেন, সারা দেশে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে মনোনয়ন দাখিল করেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এ সময় আচরণবিধি লঙ্ঘন হয়েছে বলে ইসি’র কাছে কোনো খবর পৌঁছায়নি। দলভিত্তিক মনোনয়ন গতকাল প্রস্তুত হয়নি বলে জানান ইসি সচিব। অনলাইনে মনোনয়ন পূরণের বিষয়ে সচিব বলেন, অনলাইনে সারা দেশে ৩৯টি মনোনয়ন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পূরণ করা মনোনয়ন দাখিলের সংখ্যা ২৩টি। কোনো কিছু না লিখে মনোনয়ন আপলোড করেছে ৮টি। মনোনয়ন দাখিল না করে বিভিন্ন দলিল, সনদ জমা হয়েছে। যারা অনলাইনে মনোনয়ন দাখিল করেছেন তারা সরাসরিও মনোনয়ন দাখিল করে থাকতে পারেন।

এদিকে সকাল ৯টা থেকে রাজধানীর সেগুন বাগিচাস্থ ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনীত প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেয়া শুরু হয়। এ সময় অনেক প্রার্থীকে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে আসতে দেখা গেছে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী ৫ থেকে ৭ জন মনোনয়ন জমার সময় থাকার কথা থাকলেও একেক প্রার্থী ২৫ থেকে ৩০ জনের বেশি নেতাকর্মী নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যান। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীরা দল-বল নিয়ে আসেন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে। সকাল ১১টার দিকে মনোনয়ন জমা দিতে আসেন ঢাকা-১০ আসনের মনোনীত প্রার্থী ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস।

তিনি সেগুন বাগিচা কার্যালয়ে পৌঁছানোর আগেই ১৫ থেকে ২০ জন নেতাকর্মী সেখানে উপস্থিত হন। তাপস মনোনয়ন জমা দিতে উপরে যাওয়ার সময় নেতাকর্মীরাও তার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে যান। মনোনয়ন দাখিল শেষে তাপস সাংবাদিকদের বলেন, সারা দেশে নির্বাচনের উৎসব মুখর ও আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করছে। আমি আশা করি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নষ্ট হওয়ার মতো কোনো কাজ আমরা করবো না। তাপস আরো বলেন, ২০১৪ সালে আমি নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলাম।

কিন্তু আমার বিপক্ষে যে প্রার্থী ছিলেন তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহরের শেষদিন প্রত্যাহার করায় নির্বাচন কমিশন আমাকে দুর্ভাগ্যবশত হোক আর সৌভাগ্যবশত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করেছে। তবে আশা করছি এবার অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। আমার এলাকার জনগণ তাদের ভালোবাসা ও আস্থা আমার উপর রাখবেন এবং পূর্ণ সমর্থন পাবো। মনোনয়নপত্র জমা দিতে কতজন সঙ্গে এনেছেন এমন প্রশ্নে তাপস বলেন, আমার এলাকায় চারটি থানা ও ৯ ওয়ার্ড। নেতাকর্মীরাই আমার সব। তবে বিধি-নিষেধ আমার জানা নেই। বেশ কয়েকজন আমার সঙ্গে এসেছেন।

তার আগে বিএনপি’র সাইফুল আলম নীরব প্রতিনিধির মাধ্যমে এবং আনোয়ারুজ্জামান নিজে উপস্থিত হয়ে ঢাকা-১২ আসনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেন। বিএনপি এ আসনে নীরবকেই মনোনয়ন দিয়েছে। এছাড়া ঢাকা-৪ আসন থেকে বিকল্প ধারার (যুক্তফ্রন্ট) মনোনীত প্রার্থী মো. কবির হোসেন, ঢাকা-১৩ আসন থেকে পিপলস পার্টির মনোনীত প্রার্থী শামসুল আলম মিশুক, ঢাকা-১৮ থেকে একই দলের মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ মনোনয়ন দাখিল করেন।

ঢাকা-১৮ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাহারা খাতুন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে তিনি শতভাগ আশাবাদী। পাঁচজনের বেশি সঙ্গে আনার বিষয়ে সাহারা খাতুন বলেন, পাঁচজনের বেশি যদি এসে পড়ে তাতে আমার দায় নয়। আমি পাঁচজনই এনেছি। বেলা পৌনে ১২টায় ঢাকা-১৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাদেক খান এবং বিএনপির আবদুস সালাম মনোনয়পত্র জমা দেন। এ আসনে সালামের সঙ্গে আতাউর রহমান ঢালীকেও মনোনয়ন দিয়ে রেখেছে বিএনপি।

আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে আসলামুল হক ঢাকা-১৪, মো. ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ ঢাকা-১৬, একেএম রহমউল্লাহ ঢাকা-১১ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেন। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান বলেন, বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে আমি রাজপথে ছিলাম। এ কারণে নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। জনগণ আজ নৌকার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ, নৌকাকে বিজয়ী করতে জনগণ মাঠে নেমেছে। একই আসনে ধানের শীষের প্রার্থী বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম বলেন, এখন পর্যন্ত নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন।

আমার নির্বাচনী এলাকা মোহাম্মদপুর, আদাবরে আমার আর কোনো কর্মীকে যেন গ্রেপ্তার করা না হয়। কিন্তু আমার নেতাকর্মীদের এখনো গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। মনোনয়নপত্র জমা দিতে এসে নৌকার প্রার্থী সাদেক খানের সঙ্গে কথা হয়েছে জানিয়ে সালাম বলেন, আমি উনাকে বলেছি, নির্বাচনী এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির স্বার্থে প্রয়োজনে আমরা এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে যার যার দলের পক্ষে ভোট চাইবো। দুপুর একটার দিকে মনোনয়ন জমা দিতে ২০ দলীয় ঐক্যজোটের মনোনীত প্রার্থী জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের পক্ষে দলের নেতা মতিউর রহমান রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান। তিনি লড়বেন ঢাকা-১৫ আসন থেকে।

তার কিছুক্ষণ পরেই আসেন জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী কাজী ফিরোজ রশিদ। তিনি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন ঢাকা-৬ আসনে। দুপুর পৌনে দুইটার দিকে মনোনয়ন জমা দেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক খেলোয়াড় আমিনুল ইসলাম। তাকে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছেন ঢাকা-১৪ আসনে। মনোনয়ন জমা দেয়া শেষে আমিনুল বলেন, এদেশের মানুষ মুক্তির অপেক্ষা করছেন।

যে দুঃশাসন, এই স্বৈরশাসকের হাত থেকে মুক্তির জন্য ১৬ কোটি মানুষ মুখিয়ে আছে। তারা ভোট দিতে চায়। মনোনয়ন জমা দিতে এসে গণফোরামের নেতা সুব্রত রায় চৌধুরী বলেন, নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি। নির্বাচন কমিশনের কথাবার্তা ও কার্যক্রম দেখে মনে হয় নির্বাচনকে দিন দিন তারা প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীনের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে তিনি পুরো নির্বাচনকে ধ্বংস করে দেবেন।

যদি সুষ্ঠু নির্বাচন না হয় তাহলে দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটা কলঙ্ক থেকে যাবে। আমরা যে নির্বাচনে নেমেছি শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবো। বিকাল সাড়ে চারটার দিকে মনোনয়ন জমা দিতে আসেন গণফোরামের আরেক নেতা মোস্তফা মহসীন মন্টু। তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন ঢাকা-৭ আসন থেকে।

এদিকে মনোনয়ন জমা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার কেএম আলী আজম। তিনি বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত করতে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। নির্বাচনী আচরণবিধি প্রয়োগে আমাদের ১৫ জন ম্যাজিস্ট্রেটের ১৫ টিম এবং সিটি করপোরেশনের ২টি টিম মাঠে কাজ করছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment