‘মাজারের মসজিদ’ থেকেই কোরআন নিয়েছিল ইকবাল

‘মাজারের মসজিদ’ থেকেই কোরআন নিয়েছিল ইকবাল

কুমিল্লা নগরীর পূজামণ্ডপে ইকবাল হোসেন নামের যুবকই মসজিদ থেকে সংগ্রহ করে পবিত্র কোরআন শরীফ রেখেছিল। এ বিষয়টি সিসিটিভি ফুটেজ দেখে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চিত হয়েছে।

বুধবার গণমাধ্যমে মণ্ডপে কোরআন রাখার বিষয়ে ইকবাল হোসেনের নাম আসায় সংশ্লিষ্ট মহলে তোলপাড় সৃষ্টি করে। তবে কোরআনটি কোথায় থেকে আনা হয়েছিল এটা নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়। বৃহস্পতিবার একটি সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নানুয়াদিঘীর পাড়ের অদূরে দারোগাবাড়ি মাজারের মসজিদ থেকেই কোরআন শরীফটি সংগ্রহ করে মণ্ডপে রাখেন ইকবাল।

ঘটনাস্থলের পাশেই দারোগাবাড়ি মাজার ও জামে মসজিদ। ‘ওই মসজিদ থেকে কোরআন শরীফ নিয়ে মণ্ডপে রাখা হয়েছিল’ এমন অভিযোগ বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসার পর পেশ ইমাম ইয়াছিন নূরী দাবি করেছিলেন, মসজিদে কোরআন শরীফ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে, তবে মণ্ডপে যে কোরআন পাওয়া গেছে তা নতুন, এমন কোরআন শরীফ তাদের সংগ্রহে ছিল না।

কিন্তু বৃহস্পতিবার একটি মাধ্যমে আসা ১৭ মিনিটের একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় ঘটনার দিন রাতে কয়েক দফায় ইকবাল হোসেন মাজার সংলগ্ন মসজিদে প্রবেশ করেন। রাত ১০টা ৫৮ মিনিটে তিনি মসজিদে যান। পরে বের হয়ে আসেন। এ সময় মসজিদে দুইজন মুসল্লি ছিলেন। পরে আবার রাত ২টা ১২ মিনিটে মসজিদের একটি বক্স থেকে কোরআন নামিয়ে ফ্লোরে রেখে বের হয়ে যান। সর্বশেষ রাত ২টা ১৭ মিনিটে আবারও মসজিদে গিয়ে কোরআন হাতে বের হয়ে যান।

এদিকে মণ্ডপে কোরআন রাখার বিষয়ে ইকবালের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশের পর বৃহস্পতিবার দিনভর এলাকার লোকজন ও গণমাধ্যম কর্মীরা তার বাড়িতে ভিড় করে। সে নগরীর সজানগর এলাকার বাসিন্দা নুর আহমেদ আলমের বড় ছেলে।

পুলিশ ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকটি টিম ইকবালকে ধরতে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কয়েকটি মাজারসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। তবে সে মোবাইল ফোন ব্যবহার না করায় গ্রেপ্তারে বিলম্ব হচ্ছে। তাই সোর্সের মাধ্যমে তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

এদিকে ঘটনাস্থলের আশেপাশের অন্তত ১২টি সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে মণ্ডপে কোরআন রাখা যুবক ইকবাল বলে পুলিশ নিশ্চিত হলেও এর নেপথ্যে কে আছে কিংবা কারা রয়েছে এসব বিষয়েও তদন্ত চলছে বলে পুলিশের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

পরিবারের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে ইকবাল হোসেন সবার বড়। এলাকায় ভবঘুরে হিসেবে পরিচিত ইকবাল প্রায়ই নেশা করতো। নেশার টাকার জন্য পরিবারের শোকজনের ওপর ক্ষিপ্ত হতো সে। সে কখনো বাস চালকের সহকারী, কখনো রং মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করলেও নেশার জগতে পা রাখায় কোথাও তাকে লোকজন কাজে রাখতে চাইতো না। প্রথম বিয়ে করেছেন বরুড়ায়। আয়েশা বেগম নামের সেই স্ত্রীর সঙ্গে পাঁচ বছর আগে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। সেই সংসারে তার এক ছেলে রয়েছে। দ্বিতীয় বিয়ে করেন চৌদ্দগ্রামের কাদৈ গ্রামের রুমি আক্তারকে। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রুমিও তাকে ছেড়ে গেছেন। আদালতে মামলাও করেছেন। সেই সংসারে তার একটি মেয়ে আছে।

গত শনিবার থেকে ইকবালের বাবা নুর আহমেদ আলম, মামা তাজুল ইসলাম ও ভাই সাফায়েত হোসেনকে নিয়ে পুলিশ একাধিক স্থানে অভিযান চালাচ্ছে। ইকবালের মা বিবি আমেনা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে নেশা করে। নেশার টাকার জন্য স্ত্রী ও আমাদের মারধর করতো। ১০/১২ বছর আগে থেকে সে নেশা শুরু করে। পরে বাসে ও রংয়ের কাজ করতে দেওয়া হলেও নেশার কারণে কেউ তাকে কাজে রাখতে চায়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাঝেমধ্যে বাড়ি থেকে কিছু না বলেই কোথায় যেন চলে যেত সে (ইকবাল)। সে মাজারে যেত বেশি। ১১ অক্টোবর সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি। আমার ছেলে যদি মণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার মতো পাপ করে থাকে তাহলে তার বিচার হওয়া উচিত। আইনে তার যতো বড় শাস্তি হউক

আমরা তাতে প্রতিবাদ করবো না।’ আমেনা বেগম বলেন, ‘সে কখনো মোবাইল ব্যবহার করে না, তাই কোথায় আছে তাও জানি না।’

কুসিকের কাউন্সিলর মো. সোহেল বলেন, ‘ইকবালের পরিবার আমার ভালোভাবে পরিচিত। এ পরিবারকে মাঝেমধ্যেই আর্থিক সহায়তা করি। নেশার কারণে ছেলেটির আজ এই অবস্থা হয়েছে।’

এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে আসেন পুলিশের গঠিত অনুসন্ধান দল। বৃহস্পতিবার দুপুরে অনুসন্ধান দলের সভাপতি ও পুলিশের ডিআইজি (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) ওয়াই এম বেলালুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল নানুয়ারদিঘীরপাড় এলাকায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে ঘটনাস্থলের আশেপাশের ভবন ও সড়কে স্থাপন করা কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। ১২টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে এবং স্থানীয়ভাবে তদন্তে আমরা যে যুবককে শনাক্ত করেছি তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকটি টিম মাঠে অভিযান চালাচ্ছে। মণ্ডপে কোরআন রাখার বিষয়ে ওই যুবককে কেউ সহায়তা বা প্রলোভন দিয়ে থাকলে তাকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাবে। কারণ ওই যুবকই সরাসরি মণ্ডপে কোরআন রেখেছিল। তাকে ধরতে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকটি টিম মাঠে অভিযান চলছে।’

গত ১৩ অক্টোবর নগরীর নানুয়া দিঘীর পাড় পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনায় কুমিল্লা নগরের কয়েকটি পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এছাড়া জেলার সদর দক্ষিণ ও দাউদকান্দির দুটি মণ্ডপে হামলা হয়।

এর জেরে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, নোয়াখালীর চৌমুহনী, রংপুরের পীরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় পাঁচটি, সদর দক্ষিণ মডেল থানায় দুটি, দাউদকান্দি ও দেবিদ্বার থানায় একটি মামলা হয়। এসব মামলায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

 

আপনি আরও পড়তে পারেন