মাহমুদউল্লাহর বিদায় এবং বিসিবির দায়

মাহমুদউল্লাহর বিদায় এবং বিসিবির দায়

মাশরাফি বিন মুর্তজা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ৩১০টি। ৩৬ টেস্ট ম্যাচ, ২২০ ওয়ানডে আর ৫৪ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। ৩৯০ বার ব্যাটসম্যানদের ‘ঘাতক’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। তর্কাতীত ভাবে এখন অবধি বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক মাশরাফি। এই সেদিনও তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জার্সিতে ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি ২৬৯ উইকেটের মালিক। সাকিব আল হাসান গেল মে মাসে লঙ্কা সফরে ছুঁয়েছেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’কে।

শিরোনামে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, লেখায় কেন মাশরাফি বিন মুর্তজা? -কারণ তো কিছু একটা আছেই!

দুই.
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন। এ মাসের শুরুতে জিম্বাবুয়েতে খেলা টেস্ট ম্যাচটিই সাদা পোশাকে তার সর্বশেষ। ঠিক ৫০টি টেস্ট খেলেছেন এই অফ স্পিনিং অলরাউন্ডার। ৯৪ ইনিংসে তাঁর রান ২৯১৪, গড় ৩৩.৪৯, সর্বোচ্চ অপরাজিত ১৫০, সেঞ্চুরি ৫টি, ফিফটি ১৬টি। বল হাতে উইকেট শিকারের উল্লাসে মেতেছেন ৪৩ বার।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচ চলাকালেই, তৃতীয় দিনে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের সিদ্ধান্তের কথা সতীর্থদের জানিয়ে দেন মাহমুদউল্লাহ। তাঁর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠতেই পারে; ওঠেছেও।

বর্তমানে দলের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার তিনি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের আলোচিত ‘পঞ্চপান্ডবদের’ একজন। একইসাথে তিনি টি-টোয়েন্টি দলেরও অধিনায়ক। ম্যাচ চলাকালেই একজন ক্রিকেটার যখন অবসরের কথা জানান, তখন সতীর্থদের মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতি কেমন হয়, দল কেমন ধাক্কা খায়, সেটা মাহমুদউল্লাহ খুব ভালো করেই জানেন। তাও আবার টেস্ট ম্যাচ! যেখানে টানা পাঁচদিন আপনাকে ধৈর্যের পরীক্ষায় উতরাতে হয়। কারো আকস্মিক অবসর ঘোষণা সেই ধৈর্যে ব্যাঘাত ঘটাতেই পারে, নষ্ট করতে পারে মনোসংযোগ।

মাহমুদউল্লাহ সব জেনে-শুনেই ম্যাচের তৃতীয় দিনে অবসরের কথা বললেন! বাংলাদেশ যখন একমাত্র টেস্টে জিম্বাবুয়েকে হারানোর চিন্তায় মগ্ন, তখন মাহমুদউল্লাহ নিজের আচমকা সিদ্ধান্ত জানিয়ে আঘাত হানলেন দলের আবেগের জায়গায়। ভাগ্য ভালো যে, দলটা শক্তি-মত্তায় দুর্বল জিম্বাবুয়ে। তাও তো তারা ম্যাচ শেষ দিনে একেবারে চা-বিরতি অবধি টেনে নিয়েছে! বাংলাদেশ দলের একেকজনের হাত থেকে যেভাবে ক্যাচ পড়ছিল, মনোসংযোগে ঘাটতির বিষয়টিই তখন ফুটে ওঠছিল। অন্য কোনো দল হলে হয়তো ম্যাচের ফলাফলই পাল্টে যেতো।

যেকোনো ক্রিকেটার যেকোনো সময় অবসর নিতেই পারেন। সেটা একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত। এ নিয়ে ক্রিকেটমোদীদের আফসোস থাকতে পারে, কিন্তু প্রশ্ন তোলাটা রূঢ় হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ অবসরের সিদ্ধান্তেও এখন যে একটু-আধটু প্রশ্ন ওঠছে, সেটাও ওঠতো না, যদি তিনি ম্যাচ চলাকালেই অবসরের কথা না জানাতেন। ব্যক্তিগত আবেগ, অনুভূতি, অভিমান ক্রিকেটারের থাকতেই পারে। কিন্তু আপনি যখন দায়িত্বশীল, অভিজ্ঞ; আপনাকে দেখে যেখানে জুনিয়ররা শিখবে, সেখানে আবেগের ঘোড়ায় খানিকটা লাগাম তো টানতেই হয়!

তিন.
মাশরাফি বিন মুর্তজার কথা বলছিলাম শুরুতে। দেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের একজন তিনি। লাল-সবুজের জার্সিতে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে যিনি সবচেয়ে বেশি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে যার সফলতাও সর্বাধিক। এমনকি বোলার হিসেবেও যিনি দলের সেরা পারফর্মারদের একজন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে এমন একজন ক্রিকেটারের বিদায় কেমন হওয়া উচিত ছিল?

জানি, দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসবে মাশরাফির ‘বিদায়’কে ঘিরে। না, মাশরাফি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে বলেননি যে তিনি আর খেলবেন না। কিন্তু গেল বছরের ৬ মার্চ, যেদিন অধিনায়ক হিসেবে শেষ ম্যাচ খেললেন, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিলেটের মাঠে সেই ম্যাচই হয়ে আসলে হয়ে গেছে তাঁর ‘সর্বশেষ’। এরপর বাংলাদেশ আরো অনেকগুলো সিরিজ, ম্যাচ খেলেছে, ডাক পড়েনি মাশরাফির। কোনো ঝুঁকি না নিয়েই বলে দেয়া যায়, ডাক পড়বেও না আর! মাশরাফি নিজেও সেটার আশা করেন না। আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় না বলেই বিদায়কে গ্রহণ করে নিয়েছেন তিনি।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেড় যুগ পদচারণা করেও মাশরাফির বিদায়টা সুখকর হয়নি মোটেও। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা।

এখানেই চলে আসে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের কথাও। হুট করে যেভাবে সাদা পোশাকের ক্রিকেটকে বিদায় বলেছেন তিনি, তা কী কাম্য ছিল? মাহমুদউল্লাহ নিজেও ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত সংস্করণকে এভাবে বিদায় বলতে চেয়েছিলেন? মনে হয় না!

তাহলে? এবার চলে আসে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) দায়ের বিষয়টিও। শুধু কী মাশরাফি, মাহমুদউল্লাহ? দেশের ক’জন ক্রিকেটারের ভাগ্যে আনুষ্ঠানিক বিদায় জুটেছে? ক’জন বিসিবির কাছ থেকে ‘তুমি দেশের ক্রিকেটের জন্য পরিশ্রম করেছো, তোমাকে ধন্যবাদ!’ এমন বার্তা পেয়েছেন?

চার.
সিনিয়র ক্রিকেটারদের এই যে নিরব, অনাড়ম্বর বিদায়, এর দায় কী এড়াতে পারে বিসিবি? দেশের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ক্রিকেটারদের অভিভাবক কেন সাড়ম্বরে, ঝাকজমকের সাথে ক্রিকেটারদের বিদায় দিতে পারে না? ক্রিকেটারদের সাথে বোর্ডের এতো মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব কেন!

পাকিস্তান সফরে একটি বাজে শটে আত্মহুতি দেয়ার পর টেস্ট দলে ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। এরপর দীর্ঘ প্রায় সতেরো মাস পর টেস্ট দলে ফিরলেন। দলের বিপর্যয়ে খেললেন ঝলমলে দেড়শ’ রানের এক ইনিংস। তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের তো পুনর্জন্ম হওয়ার কথা ছিল! হলো না কেন? কিসের এতো অভিমান জমা করে রেখেছিলেন তিনি?

মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে কর্তাব্যক্তিদের অনেক নেতিবাচক কথা শুনেছি আমরা। এটাও বলা হয়েছে, তাঁর উচিত সাদা বলের ক্রিকেটে মনোযোগ দেয়া। এই যে বলে দিলেন, লাল বল নয়, সাদা বলে মনোযোগ দাও; এর মাধ্যমে একজন ক্রিকেটারের মনোবলে চিড় ধরানো হয় না? তাকে নিরুৎসাহিত করা হয় না? কেউ সাময়িক ব্যর্থ হতেই পারেন। তিনি যে ফেরার লড়াই করবেন, নিজেকে আরও শাণিত করবেন, সেই পথ তো আপনারা অযাচিত কথার মাধ্যমে বন্ধ করে রাখেন!

কথা আরো থাকে। কোনো ক্রিকেটার যখন ব্যর্থ হন, তখন শীর্ষ পর্যায়ের কর্তাদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে তার নাম ধরে সমালোচনা করেন। ‘অমুক তো এটা পারে না, তমুক সেটা পারে না’! বিসিবি তো অভিভাবক, তারা তো ক্রিকেটারদের পাশে দাঁড়াবে, ভুল শোধরানোর পথ দেখাবে। তারা কেন প্রকাশ্যে সমালোচনা করবে? ক্রিকেটারদের হেয় প্রতিপন্ন করার অধিকার তো কারো নাই।

আপনারা ক্রিকেটারদের সমালোচনা করেন, আপনাদের সমালোচনা কারা করবে? ন্যূনতম আত্মসমালোচনাও তো আপনাদের নাই! বছরের পর বছর চেয়ার জুড়ে রেখেছেন, ক্রিকেটের জন্য, ক্রিকেটারদের জন্য আপনাদের অর্জন কোথায়! সাকিবের মতো বিশ্বসেরাকে যেখানে বুকে আগলে রাখবেন, তাকে নিয়েও আপনারা ‘ছেলেখেলা’ করেন! বেতন-ভাতা নিয়ে ক্রিকেটারদের আন্দোলন করতে হয়! শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটেও পাতানো ম্যাচ চলে, আপনারা দেখেও দেখেন না। ক্রিকেটারদের নাম ধরে ধরে স্টেডিয়ামের প্রেসিডেন্ট বক্সে বসে যা-তা বলেন! নির্দিষ্ট ক্রিকেটারকে ‘কালার’ করতে কেউ কেউ সংবাদমাধ্যমেও ফোন করে অনুরোধ করেন! বোর্ড পরিচালকরা বোর্ডের খরচে নিয়মিত বিদেশে যান; আর কোন দেশে আছে এটা?

পাঁচ.
বাংলাদেশের ক্রিকেটে ‘ছুড়ে ফেলার’ যে অলিখিত নীতি চলমান, মাহমুদউল্লাহ হয়তো সেটার ‘বলি’ হতে চাননি। তাঁর ভেতরে হয়তো ‘সুযোগ পেয়ে নিই, নিজেকে প্রমাণ করে বিদায় বলবো’ এই জেদ ছিল। আর সেজন্যই হয়তো এভাবে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় বলেছেন তিনি।

কিন্তু মাহমুদউল্লাহর বিদায় নয়, বরঞ্চ ওই ‘ছুড়ে ফেলার’ নীতির বিদায়ই এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে জরুরি।

আপনি আরও পড়তে পারেন