মেয়েদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করলে যে শাস্তি হবে

মেয়েদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করলে যে শাস্তি হবে

মসজিদে জামাতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেন। হজ করেছেন, প্রতি বছর জাকাতও দেন। সুদ-ঘুষ খান না, মদ পান করেন না। নষ্টামি নোংরামিতে জড়িত নন। ছেলে-মেয়েদের মাদরাসায় পড়িয়েছেন, নিজেকে দ্বীনদার ও পরহেজগার বলে দাবি করেন, কিন্তু জেনে-বুঝে, স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে মেয়েদের পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে— সব ছেলেদের নামে লিখে দেন। সামজে এ রকম নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, অমানবিক ও বিবেকহীন পিতার এখন অভাব নেই।

বড় আশ্চর্যের বিষয় হলো- আমাদের এসব কুৎসিত ও জঘন্য মানসিকতা সম্পন্ন পিতাদের কেউ কেউ এতটাই অহংকারী দাম্ভিক যে, তারা ইসলাম ও কোরআন-হাদিসের কোনো ধার ধারেন না। রাষ্ট্রীয় আইন-আদালত মানেন না। তারা বলেন- (কীসের কোরআন, হাদিস, কিসের শরিয়ত? রাখেন মিয়া আপনার শরিয়ত টরিয়ত, কোরআন-হাতিস। সম্পদ আমার, আমি নিজে তা অর্জন করেছি, সুতরাং আমার সম্পদ আমি যাকে ইচ্ছা যেভাবে ইচ্ছা তাকে সেভাবেই দিবো। আমি যা বলি সেটাই হবে)।

নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক। ভেবে দেখুন— কতো বড় আল্লাহদ্রোহী এই লোকগুলো। এখানেই শেষ নয়, এসব মুসলিম নামধারী পিতাদের কেউ কেউ এর চেয়েও জঘন্য কথাও বলে থাকেন। তারা বলেন- (মেয়েদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে, ছেলেদের নামে লিখে দিয়ে যদি আমাকে জাহান্নামে যেতে হয়— আমি জাহানামেই যাব, এতে আমার কোনো সমস্যা নেই)

কী জঘন্য কথা ও কতো বড় স্পর্ধা। আফসোস! শত আফসোস ও করুণা আমাদের এসব নিরীহ পিতাদের জন্য— যারা পার্থিব জগতের এই সামান্য সম্পদ থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করে জাহান্নামে যেতে চায়। অথচ তারা জানেন না, জাহান্নাম কতো ভয়ঙ্কর। কতো কঠিন ও ভয়াবহ আগুনের নির্মম এক শাস্তির জায়গা।

এসব পিতা-মাতার খুব ভালো করে মনে রাখা উচিত— হাশরের মাঠে মহান আল্লাহর আদালতে তাদের দাঁড়াতে হবে। সেদিন মেয়েদের প্রতি তাদের প্রতিটি যুলুমের হিসেব দিতে হবে। সেদিন আল্লাহ্ কোনো যালেম পিতা-মাতাকে ছাড় দিবেন না। সন্তানের প্রতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জুলুমের বিচার করবেন। তিনি সকল বিচারকের বিচারক। সেদিন তার বিচার থেকে জালেমরা রক্ষা পাবে না। তাদের জাহান্নামে যেতেই হবে।

আফসোস সেই সব সন্তানদের জন্যও— যাদের জন্য পিতারা মেয়েদের উপর এসব জুলুম করেন, অথচ তারা তাদের পিতাকে এ অন্যায় থেকে বাঁধা প্রদান করে না। বরং পিতার সঙ্গে একজোট হয়ে তারাও বোনদের সম্পদ গ্রাস করতে চায়। ঠুনকো অজুহাতে বোনদের তাদের পৈত্রিক সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার কূটকৌশল করে। ধর্মের খোলস পরা এসব বকধার্মিক জাহান্নামের লেলিহান শিখা। তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, জাহান্নামের তীব্র কঠিন আজাব।

ছলেবেল, কলে-কৌশলে ও বোনদরে প্রাপ্য সম্পদ থেকে তাদের বঞ্চিতকারী এসব ভাইদের ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলছেনে, ‘যে ব্যক্তি কারো উত্তরাধকিার সম্পত্তি গ্রাস করবে, অন্য র্বণনা মতে যে ব্যক্তি কারো উত্তরাধকিারী সম্পত্তি নিয়ে পলায়ন করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতরে অংশ থেকে বঞ্চিত করবনে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : )

বোনের সম্পত্তিকে মহান আল্লাহর নির্ধারিত সীমা আখ্যা দেয়া হয়েছে এবং সুষ্ঠুভাবে বুঝিয়ে দেওয়া জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এসব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের অনুসরণ করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, তারা তাতে চিরবাসী হবে এবং এটা বিরাট সাফল্য।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৩)

আর যারা বোনের সম্পত্তি বুঝিয়ে দেয় না, তাদের জাহান্নামের অপমানজনক শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নাফরমানী করে এবং তাঁর সীমারেখা লঙ্ঘন করে আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে। আর তার জন্যই রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১৪)

দেশের অন্যতম শীর্ষ আলেম ও স্কলার ড. আব্দুল্লাহ খন্দকার জাহাঙ্গীর (রহ.) মেয়েদের প্রতি জুলুমকারী পিতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এরকম মুসলমানের কবরটা গোরস্থানে নয়, শ্মশানে হওয়া উচিত। কারণ, আল্লাহর কোরআনের আইন হলো যে— মেয়েদের (সম্পদ) দিতে হবে। আর হিন্দু ধর্মের আইন হলো, মেয়েরা পাবে না। তো আপনার যখন কোরআনের আইন পছন্দ হলো না, হিন্দুদের আইন পছন্দ হলো— তখন আপনার স্থান আর মুসলমানদের গোরস্থানে হওয়া উচিত না, শ্মশানে হওয়া উচিত। এখানে সমস্যা হলো- ওই ভাই জানেন না যে, মদ খাওয়া যতটুকু হারাম— তার চেয়ে একশ কোটি গুণ বেশি হারাম হলো- কাউকে হক থেকে বঞ্চিত করা। আর নিজের মেয়েকে তার হক থেকে বঞ্চিত করা— এর থেকেও বড় গুনাহ।

এসব জালেমদের সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি  অন্যায়ভাবে  এক  বিঘত  জমি  দখল  করবে কিয়ামতের  দিনে তার গলায় সে জমি ঝুলিয়ে দেয়া হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৬১০)

মনে রাখা উচিত যে, কোনো মুসলিম মারা গেলে— তার স্ত্রী-সন্তান (স্বামীও হতে পারে) কিংবা অন্য আত্মীয়রা উত্তরাধিকার হিসেবে অবস্থাভেদে কী পরিমাণ সম্পত্তি পাবেন, তা ইসলামি শরিয়ত নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছে। আবার কেউ তার সম্ভাব্য ওয়ারিশদের নিজ হাতে কোনো সম্পদ দিতে চাইলে— তার যথাযথ নীতিমালা ও পদ্ধতি শরিয়ত বাতলে দিয়েছে। এসব নীতিমালা অনুসরণের মাধ্যমে একটি পরিবার ও সমাজ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের যোগ্য হয়ে থাকে। যখন এর বিপরিত হয়, তখনই অশান্তি ও অস্থিরতা দেখা দেয়। দ্বন্দ্ব, কলহ ও  বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ভাই-বোন বা ওয়ারিশদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানি শুরু হয়। এজন্য এসব মূর্খ-পিতা ও স্বার্থপর ভাইয়েরাই দায়ী।

মূলত ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের মাধ্যমে ওয়ারিশরা সম্পদের যে মালিকানা লাভ করে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে মীমাংসিত বিধান। এতে কারো নিজস্ব  অভিমত ও অনুমানের ভিত্তিতে এটা পরিবর্তন-পরিবর্ধন করার কোন অধিকার নেই। এতে ওয়ারিশদের কবুল করা এবং সম্মত হওয়া জরুরী নয়। যদি কেহ স্পষ্টত বলে যে, সে তার অংশ নেবে না তবুও আইনতঃ সে নিজের অংশের মালিক হয়ে যায়।

মানুষ নিজের সম্পদের বণ্টনে শরিয়তের বিপরিত আরেকটি নীতি গ্রহণ করে। সেটি হচ্ছে, কোনো সন্তানকে বেশি সম্পদ দিয়ে— অন্য সন্তানকে কম দেওয়া। হাদিসের বর্ণনায় এটাকেও নিষেধ করা হয়েছে। সাহাবি নোমান ইবনে বাশির (রা.)-এর এ বিষয়ক হাদিসটি বিখ্যাত।

নোমান ইবনে বাশির (রা.) বর্ণনা করেন, তার মা নিজ সন্তানের জন্য তার বাবার কাছে কিছু সম্পদের আবেদন করলেন। এ নিয়ে এক বছর পর্যন্ত তার বাবা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন। তারপর দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হলেন। তখন তার মা বললেন, আমার সন্তানকে দেওয়া সম্পদের ওপর রাসুলুল্লাহ (সা.) কে সাক্ষী রাখতে চাই। তখন আমার বাবা আমার হাত ধরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিয়ে গেলেন, আমি তখন ছোট্ট বালক। বাবা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! এই ছেলের মা তাকে দেওয়া সম্পদের জন্য আপনাকে সাক্ষী রাখতে চাচ্ছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন বললেন, হে বাশির! এছাড়াও কি তোমার আরও সন্তান আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। নবী কারিম (সা.) বললেন, তাদের সবাইকে কি তুমি এ পরিমাণ সম্পদ দান করেছ? তিনি বললেন, না। রাসুলে কারিম (সা.) বললেন, তাহলে এ ক্ষেত্রে আমাকে সাক্ষী রেখো না। আমি এমন জুলুমের সাক্ষী হতে চাই না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১২৪৩)

এই হাদিস থেকেই ইসলামি স্কলাররা গবেষণা করে এই বিধান দিয়েছেন যে, জীবদ্দশায় সন্তানদের মধ্যে দান করতে চাইলে— সমতা বজায় রাখতে হবে। কাউকে কাউকে কমবেশি করা যাবে না। অর্থাৎ প্রত্যেক ছেলে-মেয়েকে সমান সমান দিতে হবে। এই আইন পিতা জীবিত অবস্থায় তার সন্তানদের মধ্যে সম্পদ প্রদানের ক্ষেত্রে। তবে পিতার মৃত্যুর পর কোরআনের বিধান মতো সম্পদ বণ্টন হবে। তখন মেয়েরা ছেলেদের অর্ধেক পাবে।

বিরোধের নিষ্পত্তি যেভাবে

কোনো বিরোধ ভাই-বোনেরা আলোচনা করে নিজেদের মধ্যে আপস করে নিতে পারেন। সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগবণ্টন করে বণ্টননামা সম্পন্ন করতে পারেন। এই বণ্টননামা রেজিস্ট্রি করে নিতে হবে। বণ্টননামা করার পর যার যার অংশের নামজারি করাতে হবে। যদি কেউ কাউকে সম্পত্তি দিতে না চান কিংবা সম্পত্তি কম দিতে চান— তাহলে দেওয়ানি আদালতের আশ্রয় নিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে বঞ্চিত ব্যক্তিরা বাটোয়ারা বা বণ্টনের মোকদ্দমা করতে পারেন।

এই মামলা চলাকালে কেউ মারা গেলে তাদের উত্তরাধিকারীরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন এবং অংশ চাইতে পারেন। এ মামলায় দুইবার ডিক্রি হয়। প্রাথমিক ডিক্রির পর বণ্টন না করা হলে আদালত অ্যাডভোকেট কমিশনার নিয়োগ করে অংশ নির্ধারণ করে দিতে পারেন এবং চূড়ান্ত ডিক্রি প্রদান করেন। মামলা চলাকালীন আদালতের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে। এছাড়া কেউ কারও সম্পত্তি দখল করে নিতে বা দিতে না চাইলে স্বত্ব ঘোষণা ও দখলের মামলা দায়ের করার সুযোগ রয়েছে।

গত সপ্তাহে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মেয়েদের সম্পদের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বিগত ১০ বছরে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৭৯০ জনকে সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা দেওয়া হয়েছে। একই সময়ে এ কার্যক্রমে আওতায় মোট ১ লাখ ৬৮৮টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে বলেও বক্তৃতায় জানান প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং মজলুম ও ভুক্তভোগীরা নির্ভয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নারী বিষয়ক সংস্থা বা এনজিও গুলোর সাহায্যও নিতে পারেন। তারা ফ্রিতে আইনি সহযোগিতা দিয়ে থাকে।

ইসলামের আলোকে মিরাস, অসিয়ত ও ওয়াকফের বিধিবিধান সম্পর্কে সবপর্যায়ের মুসলমানদের জ্ঞান অর্জন এবং এ সংক্রান্ত মাসায়ালার ব্যাপক চর্চা হওয়া দরকার। বিষয়গুলো মুসলিম জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতে হবে। যেন মানুষ সঠিকটি জেনে, সে অনুযায়ী আমল করতে পারেন এবং ভুলগুলো এড়িয়ে চলার সুযোগ পায়। কেননা ইসলামের  দেওয়া  বিধান  প্রতিটি  মানুষের  জন্যই  কল্যাণ  বয়ে  আনে।  তাই পিতা বা ভাই কর্তৃক কেউ যেন তার উত্তরাধিকারী সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না হয়— তাই কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক সম্পত্তি বণ্টন হওয়া আবশ্যক ও একটি ফরজ বিধান।

 

 

আপনি আরও পড়তে পারেন