রূপগঞ্জে পানিতে বন্ধী জীবন মানুষের ভোগান্তি

রূপগঞ্জে পানিতে বন্ধী জীবন মানুষের ভোগান্তি

নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জ ঃ

বিগত কয়েক দিনের টানা বর্ষণে রূপগঞ্জের অধিকাংশ নি¤œাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব স্থানে অবস্থিত ঘরবাড়িগুলো পানিতে আটকে আছে। বিশেষ করে উপজেলার নারায়ণগঞ্জ-রূপগঞ্জ-নরসিংদী ডিএনডি বাধের ভিতর যেন ফাঁদে আটকে আছেন বসবাসকারীরা। বাধের ভিতরে বসবাসকারীদের সাথে আলাপ করে জানান যায়, সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে থাকে। নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। বিভিন্ন কারণে এখানকার পানি নিষ্কাশনের খালগুলো বন্ধ রয়েছে। কলকারখানার বিষাক্ত পানি রাস্তাঘাটসহ ঘরেও প্রবেশ করেছে। এসব পানিতে চলাচলের কারণে বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগ দেখা দিচ্ছে। বাধের ভিতরে বসবাসকারী রাবেয়া বেগম জানান, বহু আশা নিয়ে ঘর বানাইছিলাম ভাই। বালির বাধের মত আশা আমার গুড়েবালিই হয়ে গেছে ভাই। বাধই এখন আমার মত অনেকের জীবনের জন্য ফাঁদ বা গলার কাঁটা।

‘অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের লক্ষে বাঁধ দেওয়া হয়ে ছিল। সেই বাঁধের ফাঁদে আটকে এখন হারিয়ে যাচ্ছে ফসলী জমিই। ডিএনডি বাধেঁর ভেতরের তারাব পৌরএলাকা ও গোলাকান্দাইল ভুলতা এলাকার গ্রাম গুলো ঘুরেও এখন আর দেখা পাওয়া যায় না ধান-পাট কিংবা রবি ফসল। গ্রামের কৃষকরা জানান, ‘কয়েক বছর পূর্বেও কিছু জমিতে চাষ করতেন। এখন অতিরিক্ত পানির জন্য জমি গুলো পরিত্যক্ত। কৃষি পেশা ছেলে শিল্প কারখানায় কাজ করছেন তাঁরা।’ বন্যায় প্রায়ই ফসল ক্ষতি হতো। তাই অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের লক্ষে ১৯৬৫ সালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) এলাকার ৫ হাজার ৬৪ হেক্টর আয়তনের জমিতে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় তত্বকালীন সরকার। প্রকল্পটির কাজ শেষ হয় ১৯৬৮ সালে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার তারাবো, বরপা, ভুলতা ও গোলাকান্দাইল, মধ্যপাড়া, দক্ষিণপাড়া, নাগেরবাগ, বৌবাজার, বাক্মোর্চা, খালপাড়, ইসলামবাগ, নতুন বাজার, কান্দাপাড়া, বলাইখা, বিজয়নগর, মদিনানগর, তারাবো পৌরসভার তেঁতলাবো, শান্তিনগর, বাগানবাড়ি, পশ্চিম কান্দাপাড়া, উত্তর মাসাবো, যাত্রামুড়া, রূপসী ও ভূলতা ইউনিয়নের মাঝিপাড়া, সোনাব, পাচাইখা ও ইসলামপুর সহ আশপাশের এলাকায় এখন জলাবদ্ধতা। তাতে ১৫/২০ হাজার পরিবারের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অতি বৃষ্টিতে ঘর-বাড়ির উঠানে পানি উঠেছে। অনেকের বসত ঘরে ৩/৪ ফুট পানি। কারো কারো বসত ঘরে হাঁটু সমান পানি। আবার কারো বসত ঘরে কোমর সমান পানি। রাস্তা ঘাট তলিয়ে গেছে।

বাঁধের ভেতর প্রথম কয়েক দশক ফসল উৎপাদন হলেও ১৯৯০ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে ফসল উৎপান কমতে থাকে। কৃষক সরস আলী বলেন, ১৯৮৮ সালের বন্যায় সারা দেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তখন তুলনা মূলক ভালো ছিল এই অঞ্চলের মানুষের অবস্থা। তাই বন্যা পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে ডিএনডি বাঁধের ভেতর শীল্প কারখানা গড়ে উঠে। সাথে সাথে মানুষের সংখ্যাও বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে আবাসনও। এতে ফসলী জমির পরিমান ক্রমাগতই কমছিল। পাশাপাশি শিল্প কারখানা গুলো থেকে নিগত বর্জ্য ও পানি সেচ প্রকল্পের চাহিদার থেকে বেশি হওয়ায় হাজারও হেক্টর জমি ফসল আবাদের অনুপযোগী করে তুলেছে।

জমির ফসলের গাছ হলদে হয়ে মরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। গবাদি পশু অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। ঘর-বাড়িতে পানি উঠায় কেউ কেউ আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। আবার কেউ কেউ বাঁশের মাচার উপর বসবাস করছে। কয়েকটি শিল্প কারখানায়ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কোন কোন স্থানে টিউবওয়েল পানিতে তলিয়ে গেছে। সে সকল এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। তাছাড়া শিল্প কারখানার নির্গত ক্যামিকেল ও দূর্গন্ধযুক্ত কালো পানিতে দূষণ হয়ে রোগাক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। মহিলা ও শিশুরা দুর্বিসহ জীবন যাপন করছেন।

ভুলতা এলাকার শামীম মিয়া বলেন, একদিকে লকডাউন অপরদিকে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় অতি কষ্টে চলছে নিম্ন আয়ের মানুষের। তাতে দেখা দিয়েছে খাবার সংকট। শিল্প কারখানার নির্গত বর্জ্যে পানি নিষ্কাশন খালগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্প কারখানার নির্গত গরম পানি জলাবদ্ধতায় মিশে গেছে। তাতে জলাবদ্ধতার পানি কুচকুচে কালো রঙ ধারণ করেছে। এ পানিতে হাটাচলা করতে গিয়ে মানুষ চর্ম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পানিতে কামড়ায়। পানির কীট-পতঙ্গ সহ মাছ মরে যাচ্ছে। আশপাশের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।

কান্দাপাড়ার আলম মিয়া জানান, ১০/১২ বছর ধরে এখানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। পানির সাথে যুদ্ধ করে আমাদের বাঁচতে হচ্ছে। বরপা গ্রামের গৃহিনী রোকসানা আক্তার বলেন, আমার ঘরে হাঁটু সমান পানি। ঘর থেকে বের হতে পারছিনা। চুলায় আগুন জ্বালাতে পারিনা। বিশুদ্ধ পানি নেই। অনেকে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারনে এ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।

সরজমিন এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অনেক জমি এখনও কৃষি কাজ করার উপযোগী। কিন্তু চৈত্র ও বৈশাখ মাসেও সেই জমি গুলোতে পানি আটকে থাকে। ফলে অনাবাদি হয়ে উঠেছে জমি গুলো। কৃষি পেশা ছেড়ে শিল্প কারখানায় চাকরীতে যুক্ত হওয়া মোতাহার হোসেন জানান, এক দশক পূর্বেও শুধু বর্ষা মৌসুমেই এই এলাকাটির কৃষি জমি গুলোতে পানি থাকতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে পানি আর নামছে না। ফলে জমি গুলো আবাদের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। তাই কিছু জমিতে এখন মাছ চাষ করা হয়। আর অনেক জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ-‘এক ইঞ্চি জমি যেন অনাবাদি না থাকে’। সেখানে রূপগঞ্জে হাজারও হেক্টর জমি পরে আছে অনাবাদি।

এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি সম্পসারণ কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, সমস্যাটির কারণ অনুসন্ধ্যান করতে গিয়ে দেখেছি, জমি গুলো পানিতে তলিয়ে থাকলেও বিভিন্ন স্থানে খাল গুলো দখল হওয়ায় পাম্প হাউজে পর্যাপ্ত পানি পৌছাতে পারছে না।

গোলাকান্দাইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মনজুর হোসেন ভুঁইয়া বলেন, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীর প্রতীকের প্রচেষ্টায় ১টি ড্রেজার, কয়েকটি সেচ পাম্প ও বেরি বাঁধের বটতলার পাইপ লাইন স্থাপন করা হয়েছে।

রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ নুসরাত জাহান বলেন, রূপগঞ্জের বিভিন্ন জায়গার সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিষ্কাশনের কাজ চলছে। বৃষ্টি আর না হলে তা আগামী ২/৩ দিনের মধ্যেই নিরসন করা যাবে বলে আমি আশা করছি।

আপনি আরও পড়তে পারেন