রোজায় ডায়াবেটিস রোগীদের করণীয়

রোজায় ডায়াবেটিস রোগীদের করণীয়

এবারের রোজায় ভোর (ফজর) থেকে সন্ধ্যা (মাগরিব) পর্যন্ত প্রায় ১৩ ঘণ্টা না খেয়ে থাকতে হবে। রোজা না রাখলে রাত ৮টা থেকে ১০টার মধ্যে ডিনার এবং থেকে সকাল ৮টা থেকে ১০টার মধ্যে নাস্তা করলে প্রায় ১২ ঘণ্টা না খেয়েই থাকা হয়। বলা যায় এটাও রোজা রাখার সমান সময়। ধর্ম বলে, নিয়ত ঠিক থাকলে সবার পক্ষেই রোজা রাখা সম্ভব। এখন যে কাজগুলো দিনে করা হয় রমজানে সেগুলো রাতে করলেই হয়। বিশেষ করে খাবার ও ওষুধ সেবনের বেলায় এটি প্রযোজ্য। অসুস্থ মানুষ কায়িক পরিশ্রম এমনিতেও কম করে থাকেন। রোজার সময় অসুখের ভয় তাই অমূলক। ডায়াবেটিস রোগীরদের ক্ষেত্রেও ওষুধ ডোজিং ও ইনডিভিজুয়ালাইজড করলে রোজা রাখলে খুব বেশি সমস্যা হয় না। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

** ওষুধ কীভাবে খাবেন

ডায়াবেটিস যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় এবং সেটা আগে থেকেই কন্ট্রোলে থাকলে রোজায় প্রেসক্রিপশন করা খুব সহজ। নতুন রোগী হলে বা রোগ কন্ট্রোলে না থাকলে রোজায় ওষুধ সেবনের নিয়ম পরিবর্তন করা কিছুটা কঠিন হয়ে যায়। তাই বলা হয় পুরনো রোগীরা রোজার তিন মাস আগে থেকে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিজেকে কন্ট্রোলে রাখা উচিত। তবে কিছু কিছু নিজস্ব পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।

* রোজার এক মাসের জন্য নতুন ওষুধ বা নতুন রেজিমেনে না যাওয়া ভালো।

* যতদূর সম্ভব রোগীর মতামত ও পছন্দকে মূল্যায়ন করা উচিত। এখন ভ্যারাইটিস মেডিসিন মুখে খাওয়ার উপযোগী এবং ইনজেকশন পাওয়া যায় তাই এটা সম্ভব।

* যে কোনো ওষুধেই একটা ডোজ দিয়ে পারলে ভালো না হলে সর্বাধিক দুই ডোজ দিতে হবে। এখন এক্স/এম আর বা বিভিন্ন কম্বিনেশন ওষুধে সেট অসম্ভব নয়। ইনজেকশন তো দিনে দুবার, একবার বা সপ্তাহ একবার দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে। রোগীর সুবিধা, চাহিদা, পছন্দ, সামর্র্থ্য বিবেচনা করে তাই ট্যাবলেট ও ইনজেকশন ঠিক করা যায়। যারা সানফোনিলুরিয়া বা মেটফরমিন খায় তাদের জন্য এমআরএক্স ইআরএস আর (যথাক্রমে মডিফাইড রিলিজ এক্সটেন্ডেড রিলিজ, সাস্টেন্ড রিলিজ ট্যাবলেট পাওয়া যায়) রোগীর টলারেন্স আর রিকোয়রমেন্ট অনুসারে সর্বোনিু থেকে সর্বোচ্চ ডোজের একক ট্যাবলেট বাজারে আছে। সালফোনিলুরিয়ার হাইপগ্লাইসেমিয়া করার চান্স বেশি।

রোজার দিনে বাদ দিতে পারলে ভালো, না হলে একটা ডোজ এবং সেটা ইফতারে দেওয়া যাবে। ইনসুলিন দিনে দুই ডোজ পেলে তাকে সালফোনিলুরিয়া দেওয়া উচিত নয়। সালফেনিলুরিয়ার সঙ্গে মেটফরমিন কম্বিনেশন সিনগল সন্ধ্যার ডোজ ভালো। মেটফরমিনের সঙ্গে অন্য কম্বিনেশনও হতে পারে। মেটফরমিনে প্রথমদিকে স্টোমাক আপসেট হলেও সেটা অ্যাডজাস্ট হয়ে যায়। তবে এক্সটেন্ডেড রিলিজ বা ডিপিপিফোরের সঙ্গে কম্বিনেশনগুলো সাইজে বড় বিধায় অনেক ক্ষেত্রেই ডোজ কমাতে হয়, বিকল্প খুঁজতে হয়।

লিনাগ্লিপটিন সিঙ্গেল ডোজ হলে ও ভিল্ডাগ্লিপটিন সিটাগ্লিপটান দিনে দুবার খেতে হয়। ওরাল ওষুধের মধ্য সালফোনিলুরিয়ই একমাত্র হাপগ্লাইসেমিয়া ও হাইপগ্লাইসেমিয়ার উপসর্গ করে। ব্লাড গ্লুকোজ ৪ মিমোল/লিটারের নিচে নামাতে পারে। কম্বিনেশনে না দিলে অন্যগুলোর এ১সি কমানোর ক্ষমতা কম-গ্লুকোজ কমায় কম/হাইপগ্লাইসেমিয়া কম হয়। ইনসুলিন সবচেয়ে বেশি গ্লুকোজ কমানোর ক্ষমতা রাখে।

মারাত্মক হাইপোগ্লাইসেমিয়া বেশি করে ইনসুলিন। সালফেনিলুরিয়াও তাই। রোজার দিনে এ দুটি ওষুধ লাগলে এক ডোজ এবং ইফতারের সময় সন্ধ্যা বেলায় ডোজ রাখতে পরলে ভালো। মেটফরমিন গ্লিপটিন গ্লিফলোজেন ইত্যাদি ভরা পেটে দেওয়ার ওষুধগুলো রাতে যে কোনো সময় দেওয়া গেলে ও ইনসুলিন ও সালফেনিলুরিয়া ইফতারে পানি নেওয়ার পর খাওয়া যাবে।

ওষুধ নেওয়ার পর দেরি করে খাওয়া যাবে না। শর্ট বা আল্ট্রা শর্ট বা রাপিড এক্টিং ইনসুলিন দিয়ে খাবারের পরের সুগার (প্যারান্ডিয়াল) সুগার কমাতে হয়। তাই এক ডোজ ইনসুলিন ইফতারের সঙ্গে নিয়ে এবং লাগলে সালফোনিলুরিয়া ছাড়া যে কোনো ট্যাবলেট (সিঙ্গেল/কম্বিনেশন) রাতে যে কোনো সময় খেয়ে নিলেই হয়।

যদি দুই ডোজ ইনসুলিন লাগেই তবে রোজার আগের সকালের ডোজটা সন্ধ্যায় (ইফতারে) দিয়ে রাতেরটা শেষ রাতে দিতে হবে। তবে প্রথম দিকে শেষ রাতে প্রচলিত ডোজের অর্ধেক দিয়ে শুরু করতে হবে। দশদিন পর সকাল দশটায় আঙুলের মাথা থেকে টেস্ট করতে হবে এবং সুগার দশের বেশি থাকলে ডোজ বাড়বে নইলে অর্ধেক দিয়েই চলবে। জিএলপি ওয়ান এগোনিস্ট ওষুধগুলোর সুবিধা হলো সপ্তাহে এক ডোজ দিলে হয়। আগে থেকে অভ্যস্ত থাকলে এগুলো রোজার দিনে চালিয়ে গেলে খুব সুবিধা। নতুন করে শুরু করা যাবে না। কারণ প্রায় সবার বমি, বমির ভাব, পেটের ব্যথা, পাতলা পায়খানা হয় যা রোজার দিনে কাম্য নয়।

ডায়াবেটিসের সঙ্গে অন্য অসুখ টাইপ-২ ডায়াবেটিসের অধিকাংশেরই উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরেলাধিক্য থাকে। এজন্য ব্লাড প্রেশারের ওষুধ দুবেলা থাকলে ভাগ করে খাবে। বেশি পরিমাপটা সন্ধ্যায় খাবে। বাদ না দেওয়া গেলে ডাইউরেটিকগুলো সন্ধ্যা রাতে নেওয়া ভালো। হার্টের অন্য ওষুধ যে কোনো সময়/দু’ভাগ করে খাওয়া যায়। স্টাটিন (কোলেস্টেরেলের ওষুধ) ও রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ (এসপিরিন, ক্লপিডেগ্রল) খাওয়ার পর (সেহরি পছন্দ) খেতে হবে। থাইরয়েডের ওষুধ খাওয়ার এক/আধা ঘণ্টা আগে পিছে কিছু না খেলে ভালো বিধায় সেহরির আগে খাওয়া গেলে ভালো।

** রক্ত পরীক্ষা

ডায়াবেটিস রোগীরা সতর্কতার জন্য বিকাল ৫টায় এবং সকাল দশটায় সুগার টেস্ট করা যেতে পারে। রাতের বেলায় ইফতারের দুই ঘণ্টা পর গ্লুকোজ পরীক্ষা করা যায়। রান্ডম সুগার ৫ বা বেশি হলে রোজা ভাঙার দরকার নেই। ৪-এর কম হলে খেয়ে নিতে হবে; ১৭ মিমোল বা বেশি হলে রোজা ভাঙা লাগতে পারে। ইসলামী স্কলাসটিকদের মতে, রোজা রেখে রক্তের সুগার পরীক্ষা করলে রোজা ভাঙবে না।

* ডায়াবেটিস রোগীদের খাবার

রোজাদার প্রায় সব ডায়াবেটিস রোগীরা জানে তার জন্য দিনে একটা নির্দিষ্ট ক্যালরি বরাদ্দ আছে। নিয়ম মেনে খেলে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে রুচি, সামাজিক, সাংসারিক কাস্টম অনুযায়ী লঙ্ঘন ও বিপর্যয় হয়। সব মানুষের মতো ডায়াবেটিস রোগীদের ও প্রতিদিন একটা মিষ্টি ফল, এক কাপ দুধ ও কুসুমসহ একটা ডিম খেতে হয়। সকালের নাশতাকে ইফতার রাতের খাবারকে সেহরি ধরে রোজার খাদ্যবিন্যাস করা যায় অথবা মধ্যাহ্ন ভোজ মাঝ রাতের খাবার ধরে সেহরি করা যায়। ক্যালরি ঠিক রেখেই মেন্যু করতে হবে। পেয়ারা বা নাশপাতি বা আপেল বা কমলা যে কোনো একটা পুরা অথবা কয়েকটা মিলিয়ে একটার সমান ফ্রুট সালাদ খেতে পারে। একবারে না খেয়ে বারে বারে খাওয়া যায়। টকদই দিয়ে কাস্টার্ড বানিয়ে বা ডিমের স্লাইচ দই আর নাট দিয়ে সালাদ বানিয়ে খাওয়া যায়। প্রতিদিন তিনটা খেজুর বা তিনটা আঙুর বা তিনটা বরই খাওয়া যেতে পারে।

রুটি, পরাটা, নান, ভাত, পোলাও, বিরিয়ানি কোনোটা নিষেধ নেই। তবে ক্যালরি এবং পাকস্থলীর কথা খেয়াল রাখতে হবে।

** ব্যায়াম

কায়িক শ্রম নিঃসন্দেহে কঠিন। পঞ্চাশোর্ধদের শিডিউল বদলিয়ে নিতে হবে। শেষবেলার কাজ রাতে করা যেতে পারে। হাইপোগ্লাইসেমিয়ার বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। তারাবির নামাজের এক ঘণ্টা হিসাবে নিয়ে ব্যায়াম করতে হবে। কার্ডিও অর্থাৎ হাঁটা, সাইক্লিং ট্রেড মিল (যেগুলোতে হার্ট রেট বাড়) সবই সম্ভব তবে পঁয়তাল্লিশ মিনিট না করে ত্রিশ বা বিশ মিনিট করা যাবে। মাসল স্ট্রেনদেনিং বা বডি বিল্ডিং সুবিধা কারণ ডিহাইড্রেশন কম হয়। রেজিস্ট্যান্ট বা যন্ত্রপাতির ব্যায়াম চলতে পারে। ইফতারের আগে দিয়ে করা যেতে পারে, কারণ ডিহাইড্রেশন হলে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ।

লেখক : মেডিসিন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ, বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা।

 

আপনি আরও পড়তে পারেন