লোক-দেখানো আমল করলে যে শাস্তি

লোক-দেখানো আমল করলে যে শাস্তি

রিয়া করা শরিয়তে সম্পূর্ণরূপে হারাম। রিয়া মানে হলো- লোক-দেখানো কাজ, আত্মপ্রদর্শন, মুনাফিকী ও ভণ্ডামি ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায় রিয়া বলে-  সুনামের আশায় বা দুর্নামের ভয়ে সৎ আমল ও নেক কাজ করা, যাতে লোক ভালো বলে বা ভালো নজরে থাকা যায়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা রিয়াকারীর জন্য কঠিন শাস্তি রেখেছেন। তাই লৌকিকতা দেখিয়ে নিজেকে শাস্তির জন্য তৈরি না করাই মুমিনের কাজ।

জুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে শোনানোর জন্য এবং মানুষের নিকট প্রসিদ্ধি লাভ করার জন্য কোনো আমল করে— আল্লাহ তাআলা তার অবস্থা মানুষকে শুনিয়ে দেবেন। আর যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর জন্য আমল করে, আল্লাহ তাআলা তাকে রিয়াকারীর শাস্তি দেবেন। (বুখারি, হাদিস : ২/৯৬২; মুসলিম, হাদিস : ২/৪১২; তিরমিজি, হাদিস : ২/৬১; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২/৩১০; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৩/৪০; শুয়াবুল ঈমান, হাদিস : ৫/৩৩০)

হাদিসে মর্মার্থ হলো- কিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষের সামনে তার দোষ-ক্রটি প্রকাশ করে— তাকে অপমান ও অপদস্ত করবেন।

আরেক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের উপর যে জিনিসটিকে বেশি ভয় করি, তা হলো- ছোট শিরক। সাহাবিরা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! ছোট শিরক কী? তিনি উত্তর দিলেন, রিয়া। আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন যখন মানুষকে তাদের আমলের বিনিময় দেবেন, তখন রিয়াকারীকে বলবেন- যাও দুনিয়াতে যাদের তোমরা তোমাদের আমল দেখাতে— দেখ তাদের নিকট কোনো সাওয়াব পাও কিনা?’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৩৬৮১)

যেসব কারণে মানুষ রিয়া বা লৌকিকতা করে

ঈবাদাত ও নেক আমল সমূহে আল্লাহ্ তাআলাকে রাজি-খুশির পরিবর্তে দুনিয়ার মানুষের কাছে নিজের বড়ত্ব, যশ-খ্যাতি, ক্ষমতা লাভের বাসনা। সমাজের মধ্যে থাকা অবস্থায় সুন্দর করে ইবাদাত করা, লোকদের সন্তুষ্টি করার জন্য আমল করা ও নির্জনে গাফলতি করা এবং নিজেকে জাহির করার জন্য কাজ করা। বর্তমানে রিয়ার এক এক নতুন ধারার ফিতনার প্রচলন শুরু হয়েছে; যেমন- কোনো ভালো কাজ করে বা দান-সদাকা দিয়ে অথবা নিজে ইবাদাত-বন্দেগি করার বিষয় বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করা।

যেসব কাজ মনে হলেও রিয়া বা লৌকিকতা নয়

* কেউ না চাইতেই মানুষ তার ভালো কাজের প্রশংসা করে। এটা বরং মুমিনের জন্য আগাম সুসংবাদ। * দাবি-দাওয়া ছাড়াই খ্যাতি অর্জন। যেমন- কোনো আলিম কিংবা দ্বীনি শিক্ষার্থী লোকদের দ্বীন-ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে থাকেন। তাদের কাছে যা দুর্বোধ্য ও জটিল— সেগুলোর সমাধান তারা দিয়ে থাকেন। এভাবে জনগণের মাঝে কখনো কখনো তাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষিতে লৌকিকতা থেকে দূরে থাকার নামে— দ্বীনি কাজ থেকে তারা বিরত থাকা মোটেও সমীচীন হবে না। বরং তারা তাদের কাজ চালিয়ে যাবেন এবং নিয়ত ঠিক রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।

* কেউ কেউ কখনো কোনো উদ্যমী ইবাদতকারীকে দেখে— তার মতো ইবাদতে আগ্রহী হয়ে ওঠা। এটা কোনো লৌকিকতা বা রিয়া নয়। সে তার ইবাদতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত করলে— অবশ্যই ছওয়াব পাবে। * পোশাক-পরিচ্ছদ ও জুতা সুন্দর-পরিপাটি করে পরা এবং সুগন্ধি ইত্যাদি ব্যবহার করা। এর কোনোটিই রিয়া বা লৌকিকতা নয়।

* পাপ গোপন রাখা এবং সে সম্পর্কে কাউকে কিছু না বলা রিয়া নয়। বরং শারয়িভাবে আমরা নিজেদের ও অন্যদের দোষ গোপন রাখতে আদিষ্ট। কিছু লোকের ধারণা— অপরাধ প্রকাশ করা জরুরি; যাতে করে সে মুখলিছ বা খাঁটি মানুষবলে গণ্য হবে। এটি একটি ভুল ধারণা এবং ইবলিসের ধোঁকা। কেননা পাপের কথা বলে বেড়ানো— মুমিনদের মাঝে অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেওয়ার অন্তর্ভুক্ত।

* একমাত্র আল্লাহ্ তাআ’লা কে রাজি-খুশির জন্য দান-সদাকা, সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ, পরোপকার, মানুষকে অর্থ-সম্পদ বা বিভিন্নভাবে সহায়তা করলে— যদি কারও নাম ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে এগুলো রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে না।

রিয়া থেকে মুক্তির উপায়

এক. সম্মান, খ্যাতি-প্রীতি ও দেমাগ-ভাব অন্তর থেকে বের করতে হবে।

দুই. রিয়ার চেতনা এসে গেলেও তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবে না বরং নিয়ত ঠিক রেখে কাজ করে যেতে থাকবে, এভাবে আস্তে আস্তে সেটা অভ্যাসে পরিণত হবে এবং অভ্যাস থেকে ইবাদত ও ইখলাস-নিষ্ঠায় পরিণত হবে।

তিন. যে ইবাদত প্রকাশ্যে করার বিধান, তাতো প্রকাশ্যেই করতে হবে। এছাড়া অন্যান্য ইবাদত প্রকাশ করারও নিয়ত রাখবে না, গোপনে করারও উদ্যোগ নিবে না।

চার. ইবাদাত করতে হবে একমাত্র আল্লাহ্ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।

পাঁচ. কোনো কাজে কখনও গাফিলতি না করা। ছয়. মানুষকে সব সময় বড় মনে করে— নিজেকে ছোট মনে করা। সাত. নেক লোক ও হক্কানি আলেম-ওলামাদের সংস্পর্শে থাকা। ইসলামী কিতাবাদি পড়া ও প্রয়োজনে তাদের পরামর্শ নেওয়া। দশ. নিজের বিবেকের কাছে নিজের কর্মের হিসেব নেওয়া।

মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের রিয়াসহ সব ধরনের ছোট ও বড় শিরক এবং গুনাহ থেকে মুক্ত রাখুন। ইসলামের আলোয় আমাদের জীবন পরিচালিত করার তাওফিক দান করুন।

আপনি আরও পড়তে পারেন