সামান্য অক্ষরজ্ঞান পুঁজি করে জ্ঞানরাজ্যের বিশাল অঙ্গনেবিস্ময়কর পদাচারণা ঘটেছিলো আরজ আলী মাতুব্বরের

আইয়ুব হোসেন

আরজ আলী মাতুব্বর এ দেশের একজন অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত অথচ প্রাজ্ঞ, শ্রমজীবী অথচ মুক্তবুদ্ধি চর্চায় প্রাগ্রসর, লোকায়ত অথচ বিজ্ঞানসম্মত চেতনায় পরিপূর্ণ ছিলেন। এমন একজন অনন্য মানুষ সম্পর্কে এদেশের অগ্রসর ও মনস্বী বুদ্ধিজীবী ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ওপরোক্ত মন্তব্য করেছেন আজ থেকে তিন যুগ আগে। তখনো তাকে চেনেননি তেমন কেউ। নিভৃত পল্লী প্রান্তর থেকে শহুরে লেখক-পাঠকদের নজর কাড়তে পারেননি। অনেক পরে, অনেক দেরিতে চিনেছি আমরা তাকে। তার জীবন সায়াহ্নকালে, বেশ বিলম্বে আমরা এই প্রাগ্রসর লৌকিক দার্শনিকের সাথে পরিচিত হতে আরম্ভ করেছিলাম। কিন্তু এই পরিচয়পর্বটি বিস্তৃত হওয়ার আগেই, সকলে বুঝে ওঠার আগেই গত হয়েছেন তিনি।

আরজ আলী মাতুব্বর। নাগরিক পরিসর থেকে অনেক দূরে জন্ম তার। জীবনভর একটানা সংগ্রাম-সংঘাতের মধ্য একই স্থানে সারাটি জীবন বসবাস করেছেন। ভীষণ একাকীত্বে, নিরিবিলিতে নিজ গ্রামে থেকে আপন যেটুকু জমি-জিরেত তাতে ফসল ফলিয়েছেন। আর তার ফাঁকে ফাঁকে জীবন ও জগতের সত্যানুসন্ধান করে ফিরেছেন।

ইংরেজিতে ‘সেলফ টট’ বলে প্রচলিত যে কথাটি তা খাঁটি অর্থেই প্রযোজ্য আরজ আলী মাতুব্বরের ক্ষেত্রে। সাধারণ অর্থে কোনো বিদ্যাপীঠে তার শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়নি। বছর দেড়েক একটি মক্তবে ভর্তি হয়ে, অক্ষর জ্ঞানটুকু নেয়া হয়েছিলো। ব্যস, অইটুকুই। এই সামান্য অক্ষরজ্ঞান পুঁজি করে জ্ঞানরাজ্যের বিশাল অঙ্গনে বিস্ময়কর পদাচারণা ঘটেছিলো তার। সুপুরী, নারকোল আর নদনদীর জন্য অধিক পরিচিত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বর্তমান বিভাগীয় শহর বরিশাল। বরিশাল শহরের কোল ঘেঁষে কীর্তনখোলা নদী। কীর্তনখোলার এক পাড়ে বরিশাল শহর। নদীর বিপরীত দিকে চরমোনাই গ্রাম। এই দুয়ের মাঝ বরাবর বয়ে গেছে কীর্তনখোলা। শহর থেকে কীর্তনখোলা নদী বেয়ে ১০/১২ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করলে পড়বে এক শান্তসমাহিত গ্রাম। গ্রামটির নাম লামচরি। নদীর ঘাট থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পথের দূরত্বে লামচরি গ্রামের কেন্দ্রস্থলে একটি দরিদ্র কৃষিজীবী পরিবারের বাস। ‘মাতুব্বর বাড়ি’ বলে পরিচিত। লামচরি গ্রামের এ বাড়িতেই বাংলা ১৩০৭ সালের ৩ পৌষ আরজ আলী মাতুব্বরের জন্ম। পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিলো একই জেলার কালিকাপুর ও ঝর্ণাভাঙা গ্রামে। লামচরি গ্রাম একসময় জলাভূমি ছিলো। পরে চর জেগে উঠলে আরজ আলীর পিতামহ আমান উল্লা মাতুব্বর শেষ জীবনে লামচরি গ্রামে ঘরবাড়ি বানিয়ে বসত গড়ে তোলেন।

পূর্বপুরুষের সকলেই ছিলেন কৃষিজীবী। চরে তখনো মানুষের বসবাস শুরু হয়নি। ক্ষেত-খামারও হয়নি। কম মানুষজন, ঘরবাড়ি, হালচাষ হতে থাকে। বাড়ির আশেপাশের চরের জমিতে ফসল ফলানো শুরু করলেন আরজের বাবা এন্তাজ আলী মাতুব্বর। লামচরি চর পরিণত হয় লামচরি গ্রামে। ধনধান্যে ভরে ওঠে লামচরির মানুষের ঘর-গোলা। ধীরে ধীরে একসময় সম্পন্ন গ্রাম হয়ে ওঠে লামচরি। আরজ আলী মাতুব্বরের জন্মের চার বছর পর ১৩১১ সালে মারা যান তার বাবা। মৃত্যুর সময় তার উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে যান সামান্য আবাদি জমি এবং বসত বাড়িটি। জমির পরিমাণ ৫ বিঘা। আর টিনে ছাওয়া বসতের দুটো ঘর। এসময় উপর্যপুরি কয়েক বছর প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার জন্য ফসল মারা যায়। আরজ আলীরা ৫ ভাইবোন। ৩ ভাই ২ বোন। জন্মের কিছুদিন পর এক ভাই কাছেম আলী মারা যায় ১৩০১ সালে। একই বছরে আরেক ভাই ছোমেদ আলী ৩ বছর বয়সে মারা যায়। এন্তাজ আলী মাতুব্বর তার বড় মেয়ে জিগির জান বিবিকে বিয়ে দিয়ে যান। তার মৃত্যুর সময় থাকে দুই ভাই বোন, কুলসুম বিবি ও আরজ আলী। আরজ আলীর মা লালমন্নেছা বিবি স্বামী এবং ক্ষেতের ফসল হারিয়ে ছেলেমেয়েকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে তাদের।

লেখক ও গবেষক

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment