রাস্তায় দাঁড়াতেই পারেনি বিএনপি নেতাকর্মীরা

রাস্তায় দাঁড়াতেই পারেনি বিএনপি নেতাকর্মীরা

বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সিলেট সফরে যাওয়ার পথে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে নেতাকর্মীদের কোথাও দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়নি পুলিশ। জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলেই পুলিশ তাদের ওপর চড়াও হয়। গুলির ঘটনাও ঘটেছে। সিলেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ৫৬জনকে আটক করা হয়েছে। অনেক স্থানে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতামর্কীরা অবস্থান নিয়ে নৌকার পক্ষে সেøøাগান দিয়েছে বলে জানা গেছে। এসময় খালেদার গাড়ি লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপের মতো ঘটনাও ঘটেছে। তবে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর বিশ্বনাথে এসে পৌঁছলে দৃশ্যপট বদলে যায়। নেতাকর্মীরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার দুদিন আগে মাজার জিয়ারতের এ সফর রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল সকাল সোয়া ৯টার দিকে ঢাকার গুলশানের নিজ বাসভবন থেকে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী মাজার জিয়ারতের জন্য সিলেটের পথে বের হন। এরপর নারায়ণগঞ্জের আড়াউহাজার উপজেলা, নরসিংদীর শিবপুর, কিশোরগঞ্জের ভৈরব ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। অপরদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকা থেকে সিলেট মহাসড়কের দুই পাশে অবস্থিত রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এ সময় আটককৃতদের মধ্যে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়া (পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে), বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ, নরসিংদী জেলা বিএনপির সহসভাপতি সুলতান উদ্দিন মোল্লা, শহর বিএনপির সভাপতি গোলাম কবির কামাল, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন, আড়াইহাজার উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক জুয়েল আহমেদ, উপজেলা ছাত্রদল নেতা রাজীব আহমেদ, মনির হোসেন প্রমুখ রয়েছেন। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, তারা খবর পেয়েছেন, ম্যাডামের গাড়িবহর সিলেট যাওয়ার পথে পুলিশ নেতাকর্মীদের রাস্তায় দাঁড়াতেই দেয়নি। বিভিন্ন জায়গায় গ্রেপ্তার অভিযান চলায়। নেতাকর্মীরা যাতে রাস্তায় আসতে না পারে, সেজন্য কোথাও কোথাও তাদের গলিতে আটকে রাখা হয় বলেও অভিযোগ করেন রিজভী। রাত আটটায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত হজরত শাহজালাল (র.) ও হজরত শাহপরাণ (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত শেষে রাতেই সড়কপথেই ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার। মাজার জিয়ারতের সময় সফরসঙ্গী বিএনপি নেতারা মাজারে অবস্থান করলেও ভেতরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে শুধু দলের নারী কর্মীরাই উপস্থিত ছিলেন। এসময় মাজারের সামনে ও পেছনে হাজার-হাজার নেতাকর্মী উপস্থিতি ছিলেন। নরসিংদীতে খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানাতে গতকাল সকাল থেকে বিএনপি নেতাকর্মী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা মহাসড়কের ভেলানগর এলাকায় অবস্থান নেয়। অন্যদিকে বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রতিহত করতে মাঠে ছিল ছাত্রলীগ-যুবলীগ। এ সময় ছাত্রলীগ-যুবললীগ নৌকার পক্ষে মহাসড়কে মিছিল করে। এতে মুখোমুখি অবস্থান নেয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাকমীরা। উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হলে পুলিশ দুই দলের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেয়। আইনজীবীরা খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানাতে মহাসড়কের পাশে দাঁড়াতে চাইলে পুলিশ তাদের ব্যানার ও ফেস্টুন কেড়ে নেয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নরসিংদী অতিক্রম করেন। তখন বিএনপির যুগ্মমহাসচিব খায়রুল কবির খোকনসহ নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানান। খালেদা জিয়ার গাড়িবহর যাওয়ার সময় ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা ঢিল ছুড়ে মারেন এবং সরকারের পক্ষে সেøাগান দেয়। এ সময় সেখান থেকে ১১জনকে আটক করে। বিএনপি অভিযোগ করেছে, শিবপুরের কামারটেক সবুজ পাহাড় কলেজ এলাকায় দলের নেতাকর্মীদের পুলিশ লাঠিপেটা করে। খালেদা জিয়া সিলেট যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জের নেতাকর্মীরা সাইনবোর্ড, কাঁচপুর, আড়াইহাজারের পাঁচরুখী এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীরা তাঁকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য জড়ো হন। এ সময় পুলিশ তাদের ওপর চড়াও হয়। কেড়ে নেয় তাদের ব্যানার-ফেস্টুন। একপর্যায়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে গুলি চালায় পুলিশ। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম মোল্লা অভিযোগ করেন, পুলিশ প্রতিটি পয়েন্টে তাদের বাধা দিয়েছে। পাঁচরুখী এলাকায় পুলিশ নেতাকর্মীদের রাস্তায় দাঁড়াতে দেয়নি। পুলিশে বাধার মুখে নেতাকর্মীরা রাস্তা ছেড়ে নিচে নেমে গেলেও পুলিশ তাদের ধাওয়া দেয়। এ সময় পুলিশ কয়েকটি শটগানের গুলি ছুড়ে। আহত হয় অন্তত পাঁচজন। তারপর ওই এলাকায় নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালায় পুলিশ। জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ কর্মকর্তা সরাফত উল্লাহ জানান, ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ, ছাত্রদল নেতা জুয়েল আহম্মেদ, মনির হোসেন ও রাজীকে। অপরদিকে সাইনবোর্ড এলাকা থেকে পুলিশ আটক করে মহানগর বিএনপির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন, অ্যাডভোকেট আনোয়ার প্রধান ও অ্যাডভোকেট মাঈনুদ্দিন রেজাকে। বেলা সাড়ে ১১টায় আশুগঞ্জ গোলচত্বর থেকে তিন বিএনপি কর্মীকে আটক করে পুলিশ। আশুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বদরুল আলম তালুকদার বিএনপির তিনজন কর্মীকে আটকের খবর নিশ্চিত করেছেন। তবে আটককৃতদের কারও নাম সাংবাদিকদের দিতে অস্বীকার করেন তিনি। এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কৃষকদলের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কৃষকদলের যুগ্মসম্পাদক তকদীর হোসেন মো. জসিম বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সড়কপথে ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়াকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিএনপি নেতাকর্মীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য উদগ্রীব ছিল। কিন্তু আশুগঞ্জ থেকে সরাইল কুট্টাপাড়া পর্যন্ত পুলিশ কোনো নেতাকর্মীকে দাঁড়াতে দেয়নি। রাস্তায় দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেই পুলিশ লাঠিপেটা করে তাড়িয়ে দেয় বলে তিনি অভিযোগ করেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সিলেট আগমনের আগে গত ২৪ ঘণ্টায় জেলা ও মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিএনপি ও ছাত্রদলের ৩৭ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। গত রোববার সকাল থেকে গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়েছে। এরমধ্যে সিলেট জেলা পুলিশের বিভিন্ন থানা এলাকা থেকে ২৮জন এবং মহানগর পুলিশের ছয় থানা এলাকা থেকে ৯জন নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শামসুল ইসলাম সরদার এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, বিশ্বনাথ ও কানাইঘাট উপজেলায় চারজন করে আটজন, গোলাপগঞ্জে পাঁচজন, ওসমানীনগর, জকিগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, বালাগঞ্জে তিনজন করে ১২জন, বিয়ানীবাজারে দুইজন ও ফেঞ্চুগঞ্জে একজনকে আটক করা হয়েছে। আটকরা বিএনপি-ছাত্রদলের নেতাকর্মী। এছাড়া মহানগরের ছয় থানা এলাকায় রাতভর অভিযান চালিয়ে বিএনপি-ছাত্রদলের নেতাকর্মীসহ ৯জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজনের নামে পৃথক মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল বলে জানিয়েছেন মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) মুহম্মদ আব্দুল ওয়াহাব। চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সফরে থাকা মিডিয়া উইং কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জে উজানভাটি হোটেল এবং হাইওয়ে ইন হোটেলে বিরতি দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু হোটেল দুটি বন্ধ থাকায় বিরতি দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই কোথাও বিরতি না দিয়েই সিলেটে পৌঁছেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের গাড়ি বহর। তবে হবিগঞ্জ জেলার মাদবপুর উপজেলার হাইওয়ে ইন এবং পানসীসহ বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট খোলা থাকলেও সেখানে বিরতি দেয়া হয়নি। চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের আরেক সদস্য শামসুদ্দিন দিদার অভিযোগ করে বলেন, ঢাকা থেকে সিলেট রাস্তার দু-পাশে সমস্ত দোকান বন্ধ। এমনকি হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোও (খাবার হোটেল) বন্ধ রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন বলেন, যেখানে বিএনপির কর্মীরা দাঁড়ানোর কথা সেখানে তাঁরা দাঁড়িয়েছেন এবং পুলিশ তাদের কোনো বাধা দেয় নাই। তবে পুলিশ নিরাপত্তার যাতে কোনো ঘাটতি না থাকে সে ব্যাপারে সতর্ক ছিল। খালেদা জিয়ার সিলেটে আগমন উপলক্ষে শায়েস্তাগঞ্জ নতুন ব্রিজ এলাকায় পথসভার আয়োজন করে স্থানীয় বিএনপি। সকাল থেকেই জেলার নেতাকর্মীরা ওই স্থানে জড়ো হয়ে মিছিল-মিটিং করতে থাকেন। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশ নেতাকর্মীদের সরিয়ে দিয়ে মঞ্চ ও মাইক খুলে নেয়। এ সময় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সদস্য ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সৈয়দ মুশফিক আহমেদসহ চার ছাত্রদল নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। উল্লেখ্য, আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়কে সামনে রেখে সিলেটে হজরত শাহজালাল (র.) ও হজরত শাহপরাণের (র.) মাজার জিয়ারত করতে গতকাল সোমবার বিকেলে সিলেট যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। মামলার রায়কে ঘিরে রাজধানীসহ সারাদেশেই বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরপাকড় ও বাসায় বাসায় তল্লাশি চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরই ধারাবাহিকতায় সিলেটেও অভিযান অব্যাহত রয়েছে। খালেদা জিয়ার গাড়িবহর বিশ্বনাথে এসে পৌঁছলে দৃশ্যপট বদলে যায়। নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর অনুসারীরা বিশ্বনাথে খালেদা এসে পৌঁছলে নেতাকর্মীরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন। এরপর সিলেট শহরের মূল প্রবেশ পথ থেকে শুরু করে সার্কিট হাউস পর্যন্ত নেতাকর্মীরা রাস্তার দু-পাশে দাঁড়িয়ে খালেদা জিয়াকে অভিবাদন জানান। এ সময় খালেদা জিয়াও নেতাকর্মীদেরকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। এ সময় মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় সিলেট। সিলেটের সার্কিট হাউজে বিশ্রাম নিয়ে সেখানেই দুপুরের খাবার খান তিনি। চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং কর্মকর্তা শামসুদ্দিন দিদার জানান, আজ (সোমবার) বিকেলে হজরত শাহজালাল (র.) ও হজরত শাহ পরান (র.)-এর মাজার জিয়ারত শেষে সন্ধ্যায় ঢাকার উদ্দেশ্যে সিলেট ত্যাগ করবেন।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment