নওগাঁর ঠাঁ ঠাঁ বরেন্দ্র অঞ্চলে ৩ টাকায় মাসজুড়ে পানি

নওগাঁর ঠাঁ ঠাঁ বরেন্দ্র অঞ্চলে ৩ টাকায় মাসজুড়ে পানি

ফারমান আলী, নওগাঁ প্রতিনিধি :-
নওগাঁর ঠাঁ ঠাঁ বরেন্দ্র অঞ্চলে রান্না-বান্না খাওয়া গোসলসহ দৈনন্দিন প্রতিটি কাজেরই একমাত্র ভরসা পুকুর আর কুপের পানি। সেটাও ফুরিয়ে যায় ফাল্গুন-চৈত্র ও বৈশাখ মাসে। এসময়ে পানি না থাকায় বছরের ৮ থেকে ৯ মাস এ অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। শুরু হয় পানির জন্য হাঁহাঁকার। শত বছরের প্রাচীন এই দূর্ভোগ লাঘবে আশার আলো ছড়াচ্ছে ‘কমিউনিটি পানি সরবরাহ প্রকল্প’। আবার পানি সরবরাহ এই প্রকল্পের আওতায় একজন মানুষ মাত্র ৩ টাকায় মাস জুড়ে অনায়াসে পাচ্ছেন বিশুদ্ধ পানি। এতে করে বরেন্দ্র এলাকার প্রায় ৩০ হাজার হাজার পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ খাবার বিশুদ্ধ পানি পাওয়ায় তাদের চির চেনা দুর্বিসহ চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করেছে।
নওগাঁর ঠাঁ ঠাঁ বরেন্দ্র অঞ্চলে ৩ টাকায় মাসজুড়ে পানিতথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে জেলার পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুর ও পতœীতলা-ধামইরহাট উপজেলার আংশিক এলাকা ঠাঁ ঠাঁ বরেন্দ্র এলাকা হিসাবে পরিচিতি। এসব এলাকার ভুগর্ভস্থ ২শ থেকে ৩শ ফুট অভ্যন্তর পর্যন্ত রয়েছে কঠিন শিলা পাথরের স্থর। এর নিচে রয়েছে পানির স্থর। সাধারণ নলকুপ বসিয়ে বর্ষাকালে পানি পেলেও অন্য সময়ে এক ফোঁটা পানিও উঠানো যায়না এসব নলকুপ দিয়ে। পানি সংগ্রহে যুদ্ধ নামতে হয় এসব এলাকার মানুষদের। বিশেষজ্ঞদের মতে ভৌগলিক অবস্থান ও জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাবেই এ সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। প্রতি বছরই প্রকপ হচ্ছে বিশুদ্ধ খাবার পানি সংকট। খরা মওসুমে এ অঞ্চলের নারী-পুরুষদের পানি সংগ্রহে ছুটতে হতো গ্রাম থেকে প্রায় ৩/৪ কিলোমিটার দূরে গভীর নলকুপের দিকে। কোথাও বড় দিঘী অথবা পুকুড়েও যেতে হতো তাদের। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই পানি সংগ্রহেই চলে যেত দিনের অর্ধবেলা। কখনো কখনো বাধ্য হয়ে এলাকার ডোবা-নালার পানি ব্যবহার করতে হতো তাদের। এতে করে পানি বাহিত নানা রোগের প্রকোপও ছিল বরেন্দ্র এলাকার যত্রতত্র।
২০১৭ সালের জানুয়ারী মাসে জেলার সাপাহারে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রথমে স্থাপন করা হয় কমিউিনিটি বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ প্রকল্প। স্থানীয় এমপির নিজস্ব তহবিল, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, এলজিইডি বিভাগ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অর্থায়নে ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা ব্যয়ে গ্রামে সাবমারসিবল মটরের সাহায্যে প্লাস্টিকের ট্যাংকি উচু স্থানে স্থাপন করে পাইপ লাইনে ট্যাপকল বসিয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এমনকি পাইপ লাইনের মাধ্যমে নিজ নিজ উদ্যোগে বাড়ির উঠানেও পানি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই সরবরাহে শুধু বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে গ্রাহকদের। বাড়তি কোন অর্থ পানির জন্য দিতে হচ্ছে না। পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুয়ায়ী এই অর্থ নেওয়া হচ্ছে। এতে করে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য মাসে ৩/৪ টাকা করে খরচ পড়ছে। প্রাথমিক অবস্থায় জেলার সাপাহার উপজেলার ৫০টি গ্রামে এই প্রকল্প চালু করা হয়েছে। আরো ১০০টি প্রকল্প চালু করার জন্য উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে বলে উদ্যোক্তরা জানিয়েছেন। প্রতিটি সাব-মারসিবল থেকে ৪০/৫০ টি পরিবারের খাবারের পানিসহ যাবতীয় প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। মাত্র ৩ টাকায় মাস জুড়ে পানি পেয়ে এলাকাবাসীর কাছে এই প্রকল্প অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হযে উঠেছে। আবার পানির কোন অপচয়ও নেই। কারন উদ্যোক্তারা প্রতিিিট ট্যাংকির পাশেই পৃথক আরো একটি পাইপ বসিয়েছেন। ট্যাপ হতে অতিরিক্ত পানি সেই পাইপ দিয়ে আবারো ভুগর্ভস্থ গিয়ে ফ্লিটার হয়ে সেই পানি চলে আসছে মূল পাইপে।
উপজেলার গোডাউনপাড়া, কাবুলপাড়া, তুড়িপাড়া, তাজপুর পশ্চিমপাড়া, তাজপুর পূর্বপাড়া, তেহরিয়া, খোট্টাপাড়া, মানিকুড়া, দিঘীপাড়া, কল্যানপুর, মালিপুর, বড়ডাঙ্গা, ভিকনা ও ইসলামপুরসহ স্পাপিত পানি সরবরাহ প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা দেখা গেছে এসব এলাকার মানুষ এখন অনায়াসে বিশুদ্ধ খারার পানি পাচ্ছে। ট্যাংকির নিচে প্রধান ট্যাপকল থেকে গ্রামের গৃহবধুরা পানি সংগ্রহ করছে কেহ বাড়ির উঠানেই ট্যাপকলেই পানি নিচ্ছে। এসময় এসব নারীদের চোখে-মুখে ছিল আনন্দ।
উপজেলার গোডাউনপাড়া গ্রামের শিক্ষার্থী সানজিদা আক্তার জানান, ফাল্গুন-চৈত্র ও বৈশাখ মাসে কুপের পানিও পাওয়া যায়না। তখন ৩/৪ কিলোমিটার দূরে গভীর নলকুপ অথবা বড় দিঘী থেকে পানি সংগ্রহ করতে হতো। এখন সেই পানি হাতের কাছে পাচ্ছি। তিনি উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
তাজপুর পশ্চিমপাড়া গ্রামের গৃহবধু শারমিন সুলতানা জানান, বছরের পর বছর ধরে পুকুর-ডোবার পানি খেয়ে জীবন ধারন করে আসছিলেন তারা। তারা কোনদিনও আশা করেনি যে বিশুদ্ধ খাবার পানি এত অল্প খরচে পাবে। শত বছরের এই প্রাচীন দুভ্র্গো বাব-দাদাসহ তাদের কঠিন সময পার করতে হয়েছে। তিনি বলেন বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে গ্রামে গ্রামে কলেরা ডায়রিয়া, বসন্তে অনেক লোক মারা গেছে।
উসলামপুর গ্রামের আসাদুর রহমান জানান, উসলামপুর গ্রামে ৩০/৩৫ টি পরিবার রয়েছে। প্রত্যেক পরিবারেই এই পানি ব্যবহার করছে। প্রতি মাসে যে বিদ্যৃৎ বিল আসে। সেটা পরিবারের সদস্য সংখ্যা দিযে ভাগ করে যে টাকা পাওয়া যায়। সেই টাকায় বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা হয়। এতে দেখা গেছে প্রতি সদস্যকে ৩/৪ টাকা করে পরিশোধ করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, এই প্রকল্পের পানি শুধু খাবার হিসাবেই ব্যবহার হচ্ছে না, গ্রামের অনেক জমিতে রবি ফসলের আবাদেও এই পানি ব্যবহার করা হচ্ছে।
সাপাহার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল আলম শাহ্ চৌধুরী জানান, গত ১০ বছরের হিসাবে দেখা গেছে উপজেলার গ্রামগুলোতে স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ থেকে যত নলকুপ স্থাপন করা হয়েছে। তার ৭০ ভাগ নলকুপেরই কোন রকম অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়না। যেগুলো দৃশ্যমান আছে সেগুলোতেও কোন পানি উঠে না। এই খাতে সরকারের যে পরিমান অর্থ ব্যয় করা হয়েছে সেটা অপচয় করা হয়েছে। এবার সঠিক পরিকল্পনা মোতাবেক প্রতিটি প্রকল্পে সাড়ে ৪’শ ফিট পর্যন্ত গভীরে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন মোটর বসিয়ে উঁচু ট্যাংকির মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে পানি। যার সুবিধা পেতে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য মাসে দিতে হয় মাত্র ৩/৪টাকা পর্যন্ত। এই উপজেলায় ১০ হাজার পরিবারের ৫০/৫৫ হাজার মানুষ এই পানির সুবিধা ভোগ করছে। আগামীতে এই প্রকল্পের কাজ চলামান থাকবে সুবিধাভূগীর সংখ্যাও আরও বৃদ্ধি পাবে।
নওগাঁ সাপাহার কলেজ অধ্যক্ষ পরিবেশবীদ মজিবুর রহমান বলেন, ঠাঁ ঠাঁ বরেন্দ্র এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানির এরকম একটি সুযোগ করে দেওয়া সাপাহার উপজেলাবাসী গর্বিত হয়েছে। তবে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানিয় জলের ব্যবহার বাড়ানোর বিষয়ে নজর রাখার পরামর্শ দেন তিনি। এই প্রকল্পের আওতায় অতি অল্প খরচে পানি সরবরাহ করায় লোকজন অনেক উপকৃত হবেন।
নওগাঁ-১ আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, এলাকার মানুষের বিশুদ্ধ খাবার পানির দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে এবং মানণীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিক নির্দেশনা মোতাবেক যৌথ প্রচেষ্টায় গ্রাম এলাকায় কমিউনিটি বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্প চালু করা হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় উপজেলার ৫০ টি গ্রামে এই প্রকল্প চালু করা হয়েছে। সংসদীয় এলাকার আরো ১০০টি গ্রামে এই প্রকল্প স্থাপন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া জেলার বরেন্দ্র অঞ্চলসহ অন্যান্য উপজেলাতেও এই ধরনের প্রকল্প চালু করার জন্য ইতিমধ্যে প্রকল্পটির ডিজাইন করে পাঠানো হয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সংশ্লিষ্ঠ মন্ত্রনালয়কে নিদের্শনা পাঠিয়েছেন। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এলাকার পানি সরবরাহে এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment