‘নিরীহ কৃষক থেকে আদম ব্যাপারী, ফাঁকা চেকে স্বাক্ষর করে ফেঁসে গেলন শহিদুল’

‘নিরীহ কৃষক থেকে আদম ব্যাপারী, ফাঁকা চেকে স্বাক্ষর করে ফেঁসে গেলন শহিদুল’

ফরহাদ আকন্দ, গাইবান্ধা প্রতিনিধি :
আদম ব্যাপারী কিংবা বিদেশে লোক পাঠানোর ব্যাপারে কোন জড়িত না থাকলেও গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার কামারপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম কেশালীডাঙ্গা গ্রামের নিরীহ কৃষক শহিদুল ইসলামের নামে এ অজুহাতে মামলা দায়ের করেছেন একই গ্রামের ভুট্টু মিয়া। এ ছাড়া একই কারণে শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনারের আরো দুইটি মামলা দায়ের করেছেন আরো দুই ব্যক্তি। শহিদুল ইসলাম যে আদম ব্যাপারী নন এজন্য ইউপি সদস্যরা একটি প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন শহিদুল ইসলামকে।

ঘটনার অনুসন্ধানে গত মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পশ্চিম কেশালীডাঙ্গা, পূর্ব কেশালীডাঙ্গা ও কামারপাড়া স্টেশন বাজার ঘুরে মানুষদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শহিদুল ইসলাম অত্যন্ত নিরীহ ও সাদাসিধে প্রকৃতির লোক। তিনি আদম ব্যবসা বা বিদেশে লোক পাঠানোর সাথে জড়িত নন। বরং ভুট্টু মিয়া অত্যন্ত দুষ্টু প্রকৃতির লোক, দাদন ব্যবসায়ী, নারী লোভী ও বিভিন্ন গ্রামে জুয়ার আসর বসান। এ দ্বন্দ্ব সৃষ্টির আগে শহিদুল ইসলাম ও ভুট্টু মিয়ার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল।

মঙ্গলবার (১০এপ্রিল) সরেজমিনে অনুসন্ধান করে আরও জানা যায়, এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী শহিদুল ইসলামের বড় মেয়েকে আগে থেকেই পছন্দ করতেন ভুট্টু মিয়া। তার স্বামী ঢাকায় আরেকটি বিয়ে করার কথা জানতে পারলে ২০১৫ সালে দুইপক্ষকে চাপ দিয়ে থানায় ডিভোর্স করিয়ে দেন ভুট্টু মিয়া। এরপরও শহিদুল ইসলামের বাড়ীতে ভুট্টু মিয়ার যাতায়াত ছিল। ফাঁদে ফেলতেই ৪০ দিনের মাটি কাটার (কর্মসৃজন কর্মসূচি) কাজ দেওয়ার কথা বলে কৌশলে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর ভুট্টু মিয়া নিজের টাকায় কামারপাড়া অগ্রণী ব্যাংক শাখায় শহিদুল ইসলামের নামে ০২০০০১১২৬৪২৯৪ এই হিসাব নম্বরে একটি ব্যাংক একাউন্ট খুলে দেন।

পরে চেক বইয়ের দেওয়া দশটি পাতায় টাকার ঘরে ফাঁকা রেখে ভুট্টু মিয়া শহিদুল ইসলামের কাছে থেকে স্বাক্ষর করে নেন ও ব্যাংক একাউন্ট খোলার বিষয়টি কাউকে এমনকি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকেও জানাতে নিষেধ করেন। চেক বইয়ে স্বাক্ষর নেওয়ার পর একদিন শহিদুল ইসলামের বড় মেয়েকে কলেজে যাওয়ার পথে ভুট্টু মিয়া বিয়ের প্রস্তাব দিলে মেয়েটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে শহিদুল ইসলাম ধরা আছে বলে জানান ভুট্টু মিয়া। পরে বাড়ীতে এসে বিয়ের প্রস্তাবের বিষয়টি জানালে ও কিভাবে ধরা আছে বিষয়টি বাবার কাছে জানতে চাইলে শহিদুল ইসলাম ব্যাংকের ঘটনাটি খুলে বলেন।

এ ঘটনার পরে শহিদুল ইসলাম ভুট্টু মিয়ার কাছে চেক বইটি ফেরত চাইলে সেটি না দিয়ে ভুট্টু মিয়া বড় মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য শহিদুল ইসলামকে বলেন। এই বিয়েতে শহিদুল ইসলাম ও তার পরিবারের কেউই রাজি নয় বিষয়টি জানালে ভুট্টু মিয়া ক্ষেপে গিয়ে তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন ও শাসান। আর এখান থেকেই সুত্রপাত হয় শত্রুতার।

এর পরই শহিদুল ইসলামের স্বাক্ষর করা ওইসব চেকে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর ১০৬৫৪১৩ নম্বর চেকে নিজের নামে ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও ১০৬৫৪১৫ নম্বর চেকে পাশ্ববর্তী সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের কিশামত ধোপাডাঙ্গা গ্রামের আবু হানিফের নামে ১৭ ডিসেম্বর ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং উত্তর ধোপাডাঙ্গা গ্রামের মুকুল মিয়ার নামে ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা লিখে রাখেন ভুট্টু মিয়া। পরে সে চেকগুলো ব্যাংকে জমা দিলে টাকা না থাকায় শহিদুল ইসলামকে নোটিশ প্রদান করা হয়। পরে টাকা না পেয়ে চেক ডিজঅনারের মামলা করেন এই তিন ব্যক্তি।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বর্তমানে ভুট্টু মিয়ার ঘরে যে স্ত্রী রয়েছেন তিনি ৫ম তম স্ত্রী। এই স্ত্রীর সাথে মোবাইলে প্রেমের সুত্র ধরে বিদেশ থেকে পাঠানো স্বামীর প্রায় ২৫ লাখ টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে বাড়ী থেকে পালিয়ে এসে ভুট্টু মিয়ার সাথে বিয়ে হয় তার। আগের চার স্ত্রীকে নির্যাতন করায় ভুট্টু মিয়ার সাথে তাদের ডিভোর্স হয়েছে। এরমধ্যে তৃতীয় স্ত্রীর ছোট বোন ভুট্টু মিয়ার বাড়ীতে বেড়াতে আসলে তাকে অন্যত্র বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে জোড় করে বিয়ে করে বাড়ীতে তোলেন। পরে দুই বোনকেও মারধর ও নির্যাতন করায় তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়।

এদিকে শহিদুল ইসলাম যে আদম ব্যাপারী নন এজন্য কামারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ইউপি সদস্যরা একটি প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন। তাতে লেখা রয়েছে শহিদুল ইসলাম একজন দিনমজুর। জানামতে সে কোন আদম ব্যাপারী নয় এবং বিদেশে লোক পাঠানোর ব্যাপারে কোন প্রকার জড়িত নাই। আর সে প্রত্যয়ন পত্রে সংরক্ষিত আসনের সদস্যসহ ৯ জন ইউপি সদস্য স্বাক্ষর করেছেন।

এদিকে গত ৪ এপ্রিল ভুট্টু মিয়া ও আবু হানিফ ও ৮ এপ্রিল শহিদুল ইসলাম স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে উপস্থিত হয়ে গাইবান্ধা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পশ্চিম কেশালীডাঙ্গা গ্রামের এক কৃষক (৫২) বলেন, শুধু এখন কেন শহিদুল ইসলাম কোনকালেই বিদেশে লোক পাঠানোর ব্যাপারে জড়িত ছিলেন না। আগে ভুট্টু মিয়ার সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এখন বড় মেয়েকে বিয়ে না দেওয়ায় শহিদুল ইসলাম ও ভুট্টু মিয়ার সাথে ঝামেলা চলছে।

শহিদুল ইসলাম বলেন, আমি বিদেশে পাঠানোর কথা বলে কারো কাছে থেকে কোন টাকা নিইনি। ভুট্টু মিয়া মাটি কাটার কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে আমার নামে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলে দেন। পরে ফাঁকা চেকে স্বাক্ষর নিয়ে আমাকে বিপদে ফেলেছেন।

ভুট্টু মিয়া বলেন, শহিদুল ইসলাম বিদেশে পাঠানোর কথা বলে আমার ও অন্য আরো দুইজনের কাছে থেকে ১৭ লাখ টাকা নেন। পরে বিদেশে পাঠাতে ব্যর্থ হলে তার প্রদান করা চেক ব্যাংকে জমা দেওয়ার পর জানতে পাই সেই এ্যাকাউন্টে কোন টাকা নেই। পরে নোটিশ দেওয়ার পরও টাকা না পাওয়ায় আমরা শহিদুল ইসলামের নামে মামলা দায়ের করি।

শহিদুল ইসলাম কখনোই আদম ব্যাপারী ছিলেন না জানিয়ে কামারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, শহিদুল ইসলাম সাদাসিধে প্রকৃতির লোক। এ ব্যাপারে মিমাংসার জন্য কোন পক্ষই আমার কাছে আসেনি।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment