সাধ্যের বাইরে গিয়ে প্রতিশ্রুতি খালেক-মঞ্জুর

সাধ্যের বাইরে গিয়ে প্রতিশ্রুতি খালেক-মঞ্জুর

অতীতের ধারাবাহিকতার মতো এবারা যা করার ক্ষমতা নেই, যেটা সাধ্যে নেই বা দায়িত্ব নয়, সেই প্রতিশ্রুতিই দিয়ে যাচ্ছেন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রার্থীরা।

আগামী ১৫ মে যে দুই সিটি করপোরেশনে ভোট হবে তার মধ্যে খুলনায় আলোচিত দুই প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক এবং নজরুল ইসলাম মঞ্জু এরই মধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। মেয়র হলে কী করবেন, তারা তা তুলে ধরেছেন এই ইশতেহারে।

এর মধ্যে খালেকের প্রতিশ্রুতি বেশি, ৩১টি। আর মঞ্জুর প্রতিশ্রুতি তুলনামূলকভাবে কম, ১৯টি।

তবে এসব প্রতিশ্রুতির অনেকগুলোই তারা কখনও বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। কারণ, সিটি করপোরেশনের যে ক্ষমতা এবং কাজের পরিধি, তার মধ্যে এগুলো পরে না।

২০১৩ সালের মেয়র নির্বাচনের আগেও প্রার্থীরা এভাবে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আর স্বভাবতই নির্বাচিত হয়ে তার বেশিরভাগই করতে পারেননি খুলনার মেয়র মনিরুজ্জামান মনি। আসলে তিনি প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই কোনো উদ্যোগই নেননি।

এবার মনিকে বাদ দিয়ে খুলনায় মঞ্জুকে ধানের শীষ দিয়েছে বিএনপি। আর আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী প্রতীক নৌকা দিয়েছে গতবারের প্রার্থী খালেককে।

মঙ্গলবার নির্বাচনী প্রতীক পেয়ে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পর দিন খালেক তার ইশতেহার ঘোষণা করেন। এর মধ্যে তিনি যেসব প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন তার মধ্যে অন্তত চারটির ক্ষেত্রে মেয়র দলে তার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থাকবে না।

যেমন খালেক বলেছেন, তিনি মেয়র হলে নগর সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেবেন। ১৯৯৪ সালে প্রথমবার অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী মোহাম্মদ হানিফ এই সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু বিএনপি তখন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার এই দাবি যেমন মানেনি, তেমনি ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসা হানিফের নিজ দল আওয়ামী লীগও তা অগ্রাহ্য করেছে।

এরপর নানা সময় নগর বিশেষজ্ঞরা নগর সরকারের পক্ষেই কথা বলেছেন। কিন্তু সরকার তাতে রাজি নয়।

এই নগর সরকার প্রতিষ্ঠা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। সেখানে খালেক মেয়র নির্বাচিত হলে তিনি কীভাবে তা প্রতিষ্ঠা করবেন, তা স্পষ্ট নয়।

আবার শিক্ষা ব্যবহার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন খালেক। এটি সামগ্রিক একটি বিষয় যা একজন সিটি মেয়রের পক্ষে করা কঠিন বা অসম্ভব প্রায়।

খুলনার খালিশপুর ও রূপসা শিল্পাঞ্চলের উন্নয়নেরও প্রতিশ্রুতি রয়েছে খালেকের। খুলনায় যেকোনো নির্বাচন আসলেই প্রার্থীরা এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। কিন্তু সেখানে স্থানীয় মেয়রের পক্ষে কিছু করার থাকে না। তিনি সেখানে সড়কের উন্নয়ন করতে পারবেন, কিছু নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারবেন। কিন্তু এর বাইরে শিল্পে উন্নয়নে সিটি করপোরেশনের ক্ষমতা সীমিত।

আবার খুলনা মহানগরীর সম্প্রসারণ খালেকের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার। এটিও করপোরেশনের কাজ নয়। এটি করবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তবে মেয়র হলে খালেক সুপারিশ করতে পারবেন মাত্র। এর বাইরে তার বলতে গেলে কিছুই করার থাকবে না।

একইভাবে মঞ্জুও যে ১৯টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার মধ্যে অন্তত চারটির বিষয়ে মেয়র হলেও তার কিছুই করার থাকবে না।

যেমন: ভেজালমুক্ত বিশুদ্ধ খাদ্য সরবরাহ। সিটি করপোরেশন তার আওতাধীন এলাকায় খাদ্য আদালত পরিচালনা করলেও এটি দেশের সামগ্রিক বিষয়। কারণ যে খাদ্য সরবরাহ করা হবে নগরীতে তার বেশিরভাগই উৎপাদিত হবে তার নির্বাচনী এলাকার বাইরে। আর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উৎপাদিত খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে কার্ত খুলনার মেয়রের কিছুই করার থাকবে না।

খালেকের মতোই মঞ্জুও দিয়েছেন তার সাধ্যের অতীত শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি।

খালেক যেখানে খালিশপুর শিল্পাঞ্চল উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেখানে মঞ্জু আরও দুই ধাপ এগিয়ে শিল্পাঞ্চলের পুনরুজ্জীবনের পদক্ষেপ এবং কলকারখানা স্থাপনে সহযোগিতার কথা বলেছেন। সিটি করপোরেশন কীভাবে কলকারখানা স্থাপনে সহযোগিতা করবে, তার কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য মঞ্জু দেননি।

আবার নিজের নির্বাচনী এলাকার বিষয় না হলেও সুন্দরবন রক্ষায় ভূমিকা গ্রহণের কথাও বলেছেন মঞ্জু। অথচ এই বন খুলনা মহানগর থেকে বহু দূরে অবস্থিত। এই জেলাতেও নয়, এর সীমানা রয়েছে বাগেরহাটে।

এভাবে সাধ্যের অতীতে প্রতিশ্রুতি দেয়ার বিষয়ে খালেক এবং মঞ্জু- কেউ কোনো ব্যাখ্যা দেননি।

তবে দুই দুই প্রার্থীর কাছেই সামনে আগের মেয়রের ব্যর্থতার উদাহরণ ছিল। মেয়র মনিও এসব প্রায় প্রতিটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি এমনকি পাইপলাইনে খুলনায় গ্যাস আসার অঙ্গীকারও করেছিলেন। বলাইবাহুল্য, তিনি এর কিছুই করতে পারেননি।

সুশাসন এবং স্থানীয় সরকার নিয়ে কাজ করেন, এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোট আসলে সাধ্যের অতীত প্রতিশ্রুতি দিতে গিয়ে প্রার্থীরা আসলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতিই ভোটারদেরকে বীতশ্রত করে ফেলছেন। যেটা তার দায়িত্ব না, যেটা তার ক্ষমতা নয়, সেটি করবেন বলে স্বপ্ন দেখালেও পরে তারা তা করতে পারেন না। এতে পরের নির্বাচনে স্বভাবতই তারা প্রশ্নের মুখোমুখি হন, আর ভোটারারা বলে থাকেন, রাজনীতিবিদরা আসলে কিছু করেন না, কেবল স্বপ্ন দেখান।

জানতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বাস্তবায়ন অযোগ্য প্রতিশ্রুতির কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ না করলে সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবেন। এটা ওয়াদা বরখেলাপ। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব প্রতিশ্রুতি দেয়াই উচিত নয়।’

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদেরও একই মত। তিনি বলেন, ‘এগুলোর আসলে কোনো মানেই হয় না। ভোটারদের প্রার্থীরা স্বপ্ন দেখিয়ে তা ভঙ্গ করান।’

‘কোনটা ভোটাররা বিশ্বাস করবে আর কোনটা ভোটাররা অবিশ্বাস করবে তার নির্ভর করবে। সব কিছুর জন্য আইন থাকে না। মানুষ যখন বুঝবে অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তখন এক সময় তাকে ভোট দেবে না।’

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment