পাকিস্তানে আজ বুধবার সাধারণ নির্বাচনে ভোট নেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর আশ্বাস, পারস্পরিক দোষারোপ, সেনাবাহিনীর কলকাঠি নাড়া, সুযোগ বুঝে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের লম্ফঝম্ফ, হামলায় রক্তপাত আর আতঙ্ক—এসবের মধ্য দিয়ে আজ ভোট দিচ্ছেন দেশটির নাগরিকেরা। স্থানীয় সময় সকাল আটটা থেকে ভোট শুরু হয়েছে।
ডননিউজটিভির খবরে জানানো হয়, প্রথম ভোটটি পড়েছে খাইবার পাখতুনখাওয়ার চারসাদ্দাতে।
এবারের নির্বাচন দেশটির ১১তম সাধারণ নির্বাচন। প্রায় ১০ কোটি ৬০ লাখ ভোটার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের ২৭২ জনপ্রতিনিধিকে নির্বাচিত করবেন। ৫ কোটি ৯০ লাখ পুরুষ ও ৪ কোটি ৭০ লাখ নারী ভোটার ভোট দিচ্ছেন। একই সঙ্গে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ভোট নেওয়া হচ্ছে।নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মূলত পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) দল, ভুট্টো পরিবারের ঐতিহ্যবাহী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) এবং ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) মধ্যে।
ধারণা করা হচ্ছে, নওয়াজের দলের সঙ্গে ইমরানের দলের মূল লড়াইটা হবে। তবে ছেড়ে কথা বলবে না পিপিপি। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য ১৭২ আসন কোনো দল নিশ্চিত করতে না পারলে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাতি ও প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন।
স্থানীয় সময় সকাল আটটায় ভোট শুরু হলেও অনেক আগেই উৎসাহী ভোটাররা কেন্দ্রের বাইরে জড়ো হন। পিএমএল-এন প্রধান শাহবাজ শরিফ লাহোরে মডেল টাউনের একটি কেন্দ্রে নিজের ভোট দেন। এরপর তিনি সাংবাদিকদের মাধ্যমে জনগণকে নিজের ভোট প্রয়োগ করতে আহ্বান জানান। এবং অবশ্যই তা নিজের দলের জন্য চেয়েছেন। সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ভোট নেওয়া হবে। ওই সময় কেন্দ্রে থাকা সব ভোটারেরও ভোট নেওয়া হবে।নির্বাচন উপলক্ষে দেশটির নির্বাচন কমিশন আজকের দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছে।
নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে সারা দেশে ৩ লাখ ৭০ হাজারের বেশি সেনাসদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। নির্বাচনের দিন এবারই প্রথম এত বিপুলসংখ্যক সেনাসদস্য মোতায়েন করা হলো।
দেশটির ইতিহাসে পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) প্রথমবারের মতো সরকারের মেয়াদ পূর্ণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে পরের বৈধ সরকারের হাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা তুলে দেওয়া গেলে সেটি হবে ইতিহাস।ইতিহাস গড়ার এই সন্ধিক্ষণে ভয় কিন্তু পিছু ছাড়ছে না পাকিস্তানিদের। সবচেয়ে বেশি ভয় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে নিয়ে। দেশটির ৭০ বছরের ইতিহাসে প্রায় অর্ধেক সময় প্রকাশ্যে ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল সেনাবাহিনী। অন্য সময় কলকাঠি নেড়েছে আড়ালে-আবডালে। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ পিএমএল-এনের সরকার। নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের শেষের দিকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে দুর্নীতির মামলায় আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান তিনি। শুধু তা-ই নয়, তিনি রাজনীতিতে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে দলীয় প্রধানের পদও হারান। তিনি সরে দাঁড়ান, তবে সরকার ভেঙে পড়তে দেননি।
নওয়াজ এই পরিস্থিতির জন্য ক্রমাগত সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করেছেন। একই মামলায় মেয়ে মরিয়ম নওয়াজের সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। মরিয়মের স্বামী মো. সফদারকে এক বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। তিনজনই এখন কারাবন্দী। রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হওয়ায় নওয়াজ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি। আর প্রার্থী হয়েও দণ্ড পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে লড়তে পারেননি মরিয়ম-সফদার দম্পতি।পিএমএল-এনের পক্ষে নিশ্চিত জয়ী হওয়ার মতো প্রার্থী হানিফ আব্বাসিকে ভোটের মাত্র তিন দিন আগে মাদক মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। মধ্যরাতে আদালত বসিয়ে এ রায় দেওয়ার পেছনেও সেনাবাহিনীর কারসাজি দেখা হচ্ছিল। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় ইসলামাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি শওকত আজিজ সিদ্দিকির প্রকাশ্য অভিযোগে। তিনি দাবি করেন, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিচার বিভাগের কাজে নাক গলাচ্ছে। তারা তাদের পছন্দমতো বেঞ্চ গঠন করে কোন কোন মামলার রায় দিতে হবে, সেটা ঠিক করে দিচ্ছে।
এমন অভিযোগের মধ্যেই পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে সেনা কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতা দিয়েছে।