গৃহস্থ বায়ুদূষণে স্বাস্থ্যহানি

দূষণ শব্দটি শুনলেই শহরবাসী আঁতকে ওঠে। নানারকম দূষণ হচ্ছে আজকাল। এমনই এক দূষণের নাম গৃহস্থ বায়ুদূষণ (Indoor Air Pollution)। এ দূষণের নাম হয়তো অনেকের কাছে নতুন মনে হতে পারে; কিন্তু এই দূষণ সেই প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে হয়ে এসেছে- মানুষ যখন আগুন ব্যবহার করে রান্না করতে এবং নিজেকে উষ্ণ রাখতে শিখেছে তখন থেকেই এ দূষণের সূচনা।

উন্নত বা অনুন্নত যে দেশের কথাই আসুক, কমবেশি সব দেশেই ‘গৃহস্থ বায়ুদূষণ’ হয়ে থাকে এবং এর শিকার হচ্ছে মানুষ ও পরিবেশ। শীতপ্রধান দেশে ঘরকে গরম রাখতে ঘরের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়, আবার তাপের যেন আদান-প্রদান না হয় সেজন্য ঘরকে সম্পূর্ণ বায়ুরোধী করে রাখা হয়।

আগুন জ্বালাতে ব্যবহার করা হয় কয়লা, কাঠ ও গ্যাস। এগুলো পোড়ানোর সময় ধোঁয়া চিমনি দিয়ে ওপরে উঠে গেলেও এর খারাপ প্রভাব ঘরের মধ্যে বিরাজ করে। কয়লা থেকে সালফার ও কার্বনের যৌগসহ নানা রাসায়নিক গ্যাস নির্গত হয়, যেমন- কাঠ পোড়ালে সরাসরি কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়।

প্রাকৃতিক গ্যাস শতভাগ বিশুদ্ধ না হলে এ থেকে নীরব ঘাতক কার্বন মনো-অক্সাইড উৎপন্ন হয়। বায়ুরোধী ঘর হওয়ার ফলে দূষক গ্যাসসমূহ ঘরের মধ্যেই ঘুরপাক খায়; এতে করে ঘরে থাকা মানুষ বায়ুদূষণের ফলে সৃষ্ট রোগগুলোর শিকার হচ্ছে।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ নারীরা রান্নার জ্বালানি হিসেবে কাঠ, লতাপাতা, গোবর ব্যবহার করে থাকে। এ সময় মাটির চুলা থেকে যে ধোঁয়া নির্গত হয় তা সরাসরি চোখ জ্বালাপোড়ার জন্য দায়ী। এছাড়া এতে কার্বনের যৌগসহ নানা রাসায়নিক গ্যাসের উপস্থিতি থাকে, যা শ্বাসনালির প্রদাহসহ, হাঁপানি ও হৃদরোগেরও কারণ হতে পারে।

এ বছরের ৮ মে ডঐঙ কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পৃথিবীর প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ কেরোসিন, জৈব উপাদান (কাঠ, পশুর মল ও ফসল বর্জ্য) ও কয়লা দ্বারা খোলা চুলা ব্যবহার করে রান্না করে।

এর মধ্যে ২৭ শতাংশ নিউমোনিয়া, ১৮ শতাংশ স্ট্রোক, ২৭ শতাংশ ইস্কেমিক হৃদরোগ, ২০ শতাংশ ক্রনিক প্রতিরোধমূলক ফুসফুসের রোগ (সিওপিডি) এবং ৮ শতাংশ ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণে মারা যায়।

৫ বছর বয়সের কমবয়সী শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়ায় অর্ধেকেরও বেশি মৃত্যুর কারণ ঘরোয়া বায়ুদূষণ (Indoor Air Pollution) থেকে নির্গত বস্তুকণা (Particle Matter)। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় দেখা যায়, গ্যাসের চুলা ব্যবহারকারী নারীরা কাঠ কয়লার চুলা ব্যবহারকারী নারীদের চেয়ে কম স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভোগে।

এর জন্য শুধু কি জ্বালানি ‘গৃহস্থ বায়ুদূষণ’ দায়ী? না, আরও অনেক বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে হয়তো আমরা কখনও ভেবে দেখিনি যে, এগুলো আমাদের স্বাস্থ্যের ও পরিবেশের ক্ষতি করছে। যেমন-

অ্যাসবেস্টস : অ্যাসবেস্টস সাধারণত মোটরগাড়ি শিল্প ও বাড়ি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত রঙ, রঙের কোটিং, বিল্ডিং উপকরণ, ছাদ ও মেঝের টাইলসের মধ্যে অ্যাসবেস্টস পাওয়া যায়। অ্যাসবেস্টসের ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ার পর নতুন গৃহসামগ্রীতে এটি খুঁজে পাওয়া না গেলেও পুরনো গৃহসামগ্রীতে অ্যাসবেস্টসের উপস্থিতি রয়েই গেছে।

আমাদের দেশে এখনও এর ব্যবহার চলছে। যদি কারও বাড়িতে অ্যাসবেস্টস থেকে থাকে, তাহলে এটি মানবদেহে ফুসফুসের ক্যান্সার, অ্যাসবেস্তাসিস, মেসোথেলিওমা এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের মতো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।

ফরমালডিহাইড : ‘গৃহস্থ বায়ুদূষণের’ আরেকটি প্রধান কারণ ফরমালডিহাইড। ১৯৭০ সালে এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটি আর উৎপাদিত হয়নি, তবে এখনও পেইন্ট, সিলমোহর ও কাঠশিল্পে এটি খুঁজে পাওয়া যায়। এর ফলে গলা, চোখ ও নাকের জ্বালাপোড়া, সেই সঙ্গে এলার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া হতে পারে। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে এটি ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী।

জৈব দূষক : এগুলোর মধ্যে রয়েছে ফুলের টব থেকে আসা পরাগ রেণু, পোষা প্রাণীর লোম, ছত্রাক এবং কিছু ব্যাকটেরিয়া। এগুলোর কারণে অতি মাত্রায় হাঁচি, হাঁপানি রোগের লক্ষণ, গলা জ্বালা, ফ্লু এবং অন্যান্য ধরনের সংক্রামক রোগ দেখা দেয়।

ধূমপান : বদ অভ্যাসবশত অনেকেই ঘরের মধ্যে ধূমপান করে থাকে। টোব্যাকো থেকে নানারকম রাসায়নিক নির্গত হয়, যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানব স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে থাকে। এর ফলে শ্বাসযন্ত্রের যন্ত্রণা, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, ইফিসিমা, হৃদরোগ ও ফুসফুসের ক্যান্সার হতে পারে।

পরিষ্কারক দ্রব্যাদি : ঘরের মেঝে, বাথরুম ও আসবাবপত্র পরিষ্কার করতে আমরা নানারকম তরল দ্রব্য ব্যবহার করি, যা বিভিন্ন শক্তিশালী রাসায়নিক দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। বেশির ভাগ সময় আমরা এগুলো স্প্রে করে ব্যবহার করি। এর ফলে এগুলো আমাদের শ্বাসনালিতে প্রবেশ করে।

পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল না থাকায় তরল পরিষ্কারক দ্রব্যাদি শুকাতে সময় নেয়। ফলে এগুলো দীর্ঘ সময় বায়ুতে ছড়িয়ে থাকে। এর ফলে শরীরে সমন্বয়হীনতা, লিভার, মস্তিষ্ক ও কিডনিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

এতসব সমস্যা সমাধানের উপায় কী? উপায় আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। কমিয়ে ফেলতে হবে ক্ষতিকর উপাদানগুলোর ব্যবহার, সম্ভব হলে ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে। ডঐঙ বিভিন্ন দেশের গবেষকদের সঙ্গে বায়ুদূষণ কমানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে, পাশাপাশি সাধারণ মানুষদেরও সচেতন করে তুলতে নানামুখী কার্যক্রম পালন করছে।

আমাদের উচিত এমন চুলা ব্যবহার করা, যা কম জ্বালানি ব্যবহারে অধিক তাপ উৎপন্ন করে এবং দূষণ সৃষ্টি করে কম। বিল্ডিং ও ঘরের ডিজাইন এমনভাবে করা উচিত যেন পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল করতে পারে। প্রয়োজনে আবদ্ধ ঘরবাড়িতে ইনডোর এয়ার কোয়ালিটি মনিটর করা এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment