বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ ও এমপিওভুক্তির নামে শুরু হয়েছে প্রতারকচক্রের বাণিজ্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। হাজার হাজার শিক্ষক ঋণ ও ধারকর্জ করে প্রতারকদের টাকা-পয়সা দিয়ে এখন সর্বস্বান্ত। প্রতারকরা এতটাই কৌশলী যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নামে একের পর এক জাল চিঠি ও আদেশ-নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ভুয়া নির্দেশ যাচ্ছে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছেও। ভুয়া স্মারক নম্বর ও কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে এসব নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে। আবার ক্ষেত্র বিশেষে অস্তিত্বহীন কর্মকর্তার নাম ব্যবহার করেও চিঠি পাঠানো হচ্ছে। শুধু চলতি মাসেই অন্তত আটটি ভুয়া চিঠি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানো হয়েছে। চিঠি পাঠানো হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন অধিদপ্তর ও প্রকল্পের নামেও। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ২৬ জুলাই নিজেদের ওয়েবসাইটে একদিনে দুটি সতর্ক বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে (মাউশি)। গত ১২ আগস্ট ২৭১টি বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণের গেজেট হয়। আরও ৪০টি কলেজের গেজেটভুক্তি মামলাসহ নানা কারণে আটকে আছে। আর নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির আবেদন নেওয়া হয়েছে গত ৫ থেকে ১৮ আগস্ট। এগুলো এখন সরকারের বিবেচনাধীন। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র মন্ত্রণালয়ের নামে নানা ভুয়া চিঠিপত্র ছড়িয়ে অর্থ আদায়ের ফন্দি এঁটেছে। বেশ কিছুদিন ধরে এ কাজ চললেও এখন পর্যন্ত প্রতারকচক্রের কেউই চিহ্নিত হয়নি। মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপও এ বিষয়ে যথেষ্ট নয়। কেবল সতর্ক বিজ্ঞপ্তি দিয়েই মন্ত্রণালয় দায়িত্ব সেরেছে। এ সুযোগে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকরা। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এর সঙ্গে মন্ত্রণালয় ও মাউশিরই কিছু লোক জড়িত। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েছে তারা। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমকালকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের কোনো আদেশ, নির্দেশ পেয়ে সন্দেহ হলে শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তারা তা যেন অবশ্যই যাচাই করে নেন। মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি আদেশ, নির্দেশ নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। সেখান থেকেও সবাই যাচাই করে নিতে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘চিঠিপত্র, এসএমএস বা অন্য কোনোভাবে কেউ টাকা-পয়সা চাইলে সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় পুলিশকে তা জানিয়ে দিন। আমাদেরও জানান।’ জানা গেছে, বেসরকারি স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ ও নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির কথা বলে প্রতারকচক্র মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নামে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এর আগে গত বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য তালিকাভুক্ত করার কথা বলে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। সেবারও মন্ত্রণালয় কেবল গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েই দায় এড়িয়েছে। যেভাবে প্রতারণা :শিক্ষকরা জানান, এবারের প্রতারণা শুরু হয়েছে ১৫ জুলাই থেকে। সারাদেশের সাড়ে সাত হাজার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় সোয়া লাখ শিক্ষক-কর্মচারী এ মুহূর্তে এমপিওভুক্তির আশায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছেন। ঠিক সে সময়ই হাজার হাজার বেসরকারি স্কুল-কলেজে ভুয়া চিঠি পাঠিয়ে তাদের অনলাইনে তালিকাভুক্ত হতে এবং ইউজার আইডির পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করতে বলা হয়। এ জন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট নম্বরও দেওয়া হয় এবং শিক্ষকপ্রতি দুই হাজার টাকা করে পাঠাতে বলা হয়। এরই মধ্যে এ প্রক্রিয়ায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষকের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) জাবেদ আহমেদ স্বাক্ষরিত এক সতর্কবার্তায় বলা হয়, নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির লক্ষ্যে একটি প্রতারকচক্র শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্টের ভুয়া স্বাক্ষরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পত্র প্রেরণ করেছে। পত্রে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড (মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট), গফ. গড়হঁধৎ ঐড়ংংধরহ অ/ঈ ঘড়: ৭০১৭০১৯৬২২০৭৬তে ২০০০ টাকা জমা দিয়ে টংবৎ ওউ ও চধংংড়িৎফ সংগ্রহের জন্য বলা হয়েছে। এর সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের কোনো সংশ্নিষ্টতা নেই।’ এ বার্তায় এ ধরনের প্রতারকচক্র থেকে সংশ্নিষ্ট সবাইকে সাবধান থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এমপিওভুক্তি-সংক্রান্ত নির্দেশাবলি এ বিভাগের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে (িি.িংযবফ.মড়া.নফ) প্রকাশ করা হয়। কেবল তার ভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণের জন্য সংশ্নিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করছি।’ সূত্র জানায়, নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে দেওয়ার নামে মন্ত্রণালয়, মাউশি ও মাঠ পর্যায়ের একশ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং দালালদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটই জাতীয়করণ ও এমপিওভুক্তকরণের নামে সারাদেশ থেকে নানা কৌশলে টাকা-পয়সা আদায় করছে। বেতন বাড়ানোর প্রতারণা :একইভাবে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) নামে একটি ভুয়া চিঠি সারাদেশের জাতীয়করণ হতে যাওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানো হয়। মাউশির সহকারী পরিচালক (কলেজ-৩) ফারহানা আক্তারের জাল স্বাক্ষরে পাঠানো এ চিঠিতে বলা হয়, ‘জাতীয়করণ প্রক্রিয়াধীন থাকায় কলেজগুলোর তহবিল থেকে ও ব্যাংকে সংরক্ষিত অর্থ ব্যয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নির্দিষ্ট আয়ের প্রাপ্ত খাতের অর্থ সংকুলান সাপেক্ষে নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন তাদের মূল বেতন পর্যন্ত বর্ধিত করা যেতে পারে।’ এ চিঠি পাওয়ার পর সারাদেশের বেসরকারি কলেজগুলোর নন-এমপিও শিক্ষকদের মধ্যে চাঞ্চল্য পড়ে যায়। সহকারী পরিচালক (কলেজ-৩) ফারহানা আক্তার সমকালকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো চিঠি আমি সই করিনি। এমন কোনো নথিও নেই। পুরো বিষয়টিই ভুয়া।’ এরপর ২৬ জুলাই মাউশির পক্ষ থেকে তাদের ওয়েবসাইটে এ চিঠির বিষয়ে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। তথ্য চেয়ে প্রতারণা :গত ১ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নামে আরও একটি ভুয়া চিঠি সারাদেশের সব জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসে গিয়ে পৌঁছে। ওই চিঠিতে নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের নিজ প্রতিষ্ঠানের প্যাডে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ছক অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান প্রধানের নাম, তথ্য আদান-প্রদানের ই-মেইল এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানের মোবাইল নম্বর ই-মেইল করতে বলা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জানায়, এ রকম কোনো চিঠি তারা ইস্যু করেননি। কথিত ওই চিঠিতে স্বাক্ষরদাতা বাজেট শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব জাহাঙ্গীর আলম। বাস্তবে এই নামে বাজেট শাখায় কোনো সিনিয়র সহকারী সচিব নেই। ময়মনসিংহের জেলা শিক্ষা অফিসার রফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘ডাকযোগে এই চিঠি ১৫ জুলাই তিনি পান। পরে তার অধীন সব উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে পাঠিয়ে দেন। চিঠিটির বিষয়ে তিনি নিজেও সন্দিহান ছিলেন।’ একটি সূত্র জানায়, নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে দেওয়ার নামে মন্ত্রণালয়, মাউশি ও মাঠ পর্যায়ের একশ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং দালালদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটই জাতীয়করণ ও এমপিওভুক্তকরণের নামে সারাদেশ থেকে নানা কৌশলে টাকা-পয়সা আদায় করছে। স্টুডেন্ট সাপোর্টের নামেও প্রতারণা :রাজধানীর আরেকটি প্রতারকচক্র ‘স্টুডেন্ট সাপোর্ট প্রোগ্রাম ফর সেকেন্ডারি এডুকেশনে’র নামে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অভিনব প্রতারণা শুরু করেছে। তারা শিক্ষার্থীদের আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচির কথা বলে রেজিস্ট্রেশন করার জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছে। ওই চিঠিতে কয়েকটি মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়। ছাত্রছাত্রীরা যোগাযোগ করলে তাদের জানানো হয়, তারা ঘরে বসে মাসিক ৪০০ টাকা করে অর্থসহায়তা পাবে। এ জন্য তাদের রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ ৫০ টাকা ‘বিকাশ’ করে পাঠাতে হবে। রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল, ভিকারুননিসা নূন স্কুলসহ সারাদেশের প্রায় ৩ হাজার স্কুলে এমন চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে সই করেছেন তথাকথিত ‘স্টুডেন্ট সাপোর্ট প্রোগ্রাম ফর সেকেন্ডারি এডুকেশনে’র পরিচালক প্রফেসর এনএমএস উদ্দিন। তার স্বাক্ষরে সরকারি চিঠির মতো করে সরকারি মনোগ্রাম ব্যবহার করে এ ভুয়া চিঠি পাঠানো হচ্ছে। এ ভুয়া চিঠিতে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্যও ৩০ হাজার করে টাকা বিকাশের মাধ্যমে পাঠাতে বলা হয়েছে। প্রতারকচক্র তাদের অফিসের ঠিকানা হিসেবে ৩/খ/৪-পরীবাগ, নকশী স্টোর, ঢাকা উল্লেখ করেছে।
আপনি আরও পড়তে পারেন
-
ব্যাংকের ভূয়া চালান কপি দিয়ে শিক্ষা অফিস সহকারীর জালিয়াতির অভিযোগ
September 18, 2024 admin Comments Off on ব্যাংকের ভূয়া চালান কপি দিয়ে শিক্ষা অফিস সহকারীর জালিয়াতির অভিযোগদোহার (ঢাকা) প্রতিনিধি. ঢাকার দোহার উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী ফিরোজ আলমের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ... -
আদালত চত্বরে আসামিদের ওপর হামলা গ্রহণযোগ্য নয়: আইন উপদেষ্টা
August 28, 2024 নিউজ ডেস্ক Comments Off on আদালত চত্বরে আসামিদের ওপর হামলা গ্রহণযোগ্য নয়: আইন উপদেষ্টাআদালত চত্বরে আসামিদের ওপর হামলা করার বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের... -
সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আলী আরাফাত গ্রেপ্তার
সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতকে পুলিশ। মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) গুলশান থেকে তাকে...