এক ডুবে ইংলিশ চ্যানেল পার হতে চান মিজানুর রহমান চৌধুরী

স্টাফ রিপোর্টার, নওগাঁঃ

তিনি মাছ কিংবা পানকৌড়ি নন যে দিবানিশি পানির সঙ্গে মিতালি করে জীবনটা কাটিয়ে দেবেন পানিতে। অন্য দশটা রক্ত মাংসের মানুষের মতো তিনিও একজন মানুষ। তবে অন্য সাধারণ মানুষের চেয়ে তিনি আলাদা অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এজন্য যে, তিনি একাধারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন পানির নিচে অনায়াসেই কাটিয়ে দিতে পারেন। একইসঙ্গে স্বপ্নও দেখেন তিনি এক ডুবে ব্রিটেনের ইংলিশ চ্যানেল পার হতে। এই অসাধ্য কাজটি করতে বরাবরই প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যে একটানা ৭২ ঘণ্টা পানির নিচে থেকে রেকর্ড সৃষ্টিকারী এই বিরল ব্যক্তিত্বকে উপাধি দেয়া হয়েছে মৎস্যমানব হিসেবে। নাম তার মিজানুর রহমান চৌধুরী। কে এই মৎস্যমানব মিজান চৌধুরী এবং কীভাবে তিনি বিশ্বে বিরল একটি কাজকে সাধনা করে এ পর্যন্ত টেনে এনে এখন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে স্থান করে নেয়ার প্রচেষ্টারত আছেন, আসুন আমরা তা জেনে নেই।

কে এই মিজান চৌধুরী: বর্তমানে কুমিল্লা নগরীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান চৌধুরী মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামমুখর শেষ পর্যায়ের সময়ে ১৯৭১ সালের ১২ নভেম্বর চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার আতিশ্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মো. আলী আর্শ্বাদ চৌধুরী ও মাতা ফজিলত চৌধুরীর ৫ ছেলের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দীর্ঘ ২৩ বছর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত থেকে অবসর গ্রহণ করেন ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। বর্তমানে কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার মোহাম্মদপুর এআর উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। তার স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন আঁখি লালমাই ডিগ্রি কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

যেভাবে মৎস্যমানবে পরিণত হন মিজান চৌধুরী: প্রাইমারি গণ্ডি পেরিয়ে হাই স্কুলে পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাঁতার এবং পানি এই দু’টির প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন মিজান চৌধুরী। একপর্যায়ে সখ হয় পানির নিচে ডুব দিয়ে থাকা। এই সখ একসময় তার নেশা হয়ে ওঠে। যেই নেশা তাকে আজ খ্যাতির চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসছে। ১৯৮৩ সালে যখন তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখন থেকে তিনি পানির নিচে ডুব দিয়ে থাকার প্র্যাকটিস করতে থাকেন নিয়মিত। তখন তিনি স্থানীয় মতলব থানার কাচিয়ারা হাই স্কুলে শাহ আলম, মতিন, ইব্রাহিম ও মিজান নামের এই চার বন্ধুর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে স্কুলের দীঘিতে নেমে পড়েন কে কত বেশি সময় ধরে ডুবে থাকতে পারে। কিন্তু মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে চার বন্ধু পানি থেকে উঠে গেলেও উঠলেন না মিজান চৌধুরী। ছিলেন একটানা ৮ মিনিট। তখনি সারা এলাকায় হই চই পড়ে যায়। আর মিজান চৌধুরীর মতে এটাই ছিল পানিতে ডুবে থাকার রেকর্ড গড়ার ক্ষেত্রে তার টার্নিং পয়েন্ট। এরপর শুরু করলেন টানা অনুশীলন।

দীর্ঘ ১২ বছর একটানা অনুশীলনের পর ১৯৯৪ সালে জীবনে প্রথমবারের মতো তার সুযোগ আসে মৎস্যমানব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত বা স্বীকৃতি পাওয়ার । এ বছর কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার ১নং কালিরবাজার ইউনিয়নের মনশাষন গ্রামের কৃতী সন্তান ও বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের যুগ্ম সচিব বোরহান উদ্দিন ভূঁইয়ার পুকুরে একটানা ৩০ ঘণ্টা পানির নিচে ডুবে থাকার প্রথম প্রদর্শনীতে অংশ নেন। এই প্রদর্শনীটির আয়োজক ছিলেন তৎকালীন কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক রূপসী বাংলার সম্পাদক প্রয়াত অধ্যাপক আবদুল ওহাবসহ স্থানীয় নেতারা। এই প্রদর্শনীর খবর ছড়িয়ে পড়লে তৎকালীন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার প্রয়াত হুমায়ুন খান পন্নী এবং কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কাতেবুর রহমান তাকে সংবর্ধিত করেন। এর এক বছর পরেই ১৯৯৫ সালে নিজ গ্রাম চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার আতিশ্বর গ্রামের পুকুরে ১৮ ঘণ্টার প্রদর্শনী করেন। ১৯৯৬ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা সদরের নাগবাড়ীর পুকুরে নূর সমাজকল্যাণ সংস্থার উদ্যোগে ২৪ ঘণ্টার ডুবন্ত প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।

২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল টাঙ্গাইল জেলার ১নং কালমেঘা ইউনিয়নে এবং একই বছর ১ মে চাঁদপুরের মতলব উপজেলার ঘোড়াধারি গ্রামের প্রধানিয়া বাড়ির পুকুরে ২৪ ঘণ্টা ডুবন্ত প্রদর্শনী করেন। একই বছর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এমপিকে প্রধান অতিথি করে চাঁদপুর জেলা প্রশাসক আবু মো. মনিরুজ্জামান, কচুয়া উপজেলার ইউএনও এ কে এম কামরুজ্জামান ও কচুয়া পৌরসভার মেয়র জাহিদ হাসান দুলালের ব্যবস্থাপনায় কচুয়া সরকারি হাই স্কুল মাঠ সংলগ্ন পুকুরে ৭২ ঘণ্টার পানিতে ডুবে থাকার প্রদর্শনী করা হয়। এই ৭২ ঘণ্টা প্রদর্শনী সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর থেকেই জনগণ তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৎস্যমানব হিসেবে উপাধি দেয়। এরপর ২০১৭ সালের ২৬ মার্চ দেবিদ্বার দুয়ারিয়া এজি মডেল একাডেমির অধ্যক্ষ আবু মো. সেলিম ভূঁইয়ার উদ্যোগে এক ডুবন্ত প্রদর্শনী করা হয়। আর সর্বশেষ প্রদর্শনী করেন চলতি বছরের পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল কুমিল্লার দেবিদ্বারে। এখানে নববর্ষের দিন তিনি ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট পানিতে ডুব দিয়ে থাকেন। এ সময় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। এ ছাড়াও মিজানুর রহমান চৌধুরী সেনাবাহিনীতে চাকরি করাকালীন (১৯৯১-২০১৪) একাধিক ডুবন্ত প্রদর্শনীতে অংশ নেয়াসহ এ পর্যন্ত প্রায় ২৫/৩০টি প্রদর্শনীতে অংশ নেন তিনি।

কীভাবে পানিতে ডুবে থাকেন ও খাওয়া-দাওয়া করেন মিজান: মৎস্যমানব মিজান চৌধুরী দীর্ঘক্ষণ পানির নিচে ডুবে থাকলেও তার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তিনি এ পর্যন্ত টানা ৭২ ঘণ্টা পানির নিচে ডুবে থেকেছেন এবং আরো অনেক সময় নিয়ে তিনি থাকতে পারবেন বলে জানান। তিনি পানির নিচে চা, দুধ, ফল, চকলেট ও অন্যান্য খাবার গ্রহণ করেন। হাতের ইশারায় দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দিয়ে থাকেন। তিনি ৩/৪ ফুট পানির নিচে বাঁশের খুঁটি গেড়ে চেয়ারে বসে থাকেন।

মৎস্যমানব মিজানের লক্ষ্য: মৎস্যমানব মো. মিজানুর রহমান চৌধুরীর আজীবনের লালিত স্বপ্ন এক ডুবে ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়া। তার স্পষ্ট বক্তব্য, ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার মতো সমস্ত যোগ্যতাই মহান আল্লাহর রহমতে আমার আছে। কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষ আমি পাচ্ছি না যোগাযোগ করার জন্য। তিনি এজন্য বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী একটু চেষ্টা করলেই আমি এক ডুবে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকাকে তুলে ধরতে পারব ইনশাআল্লাহ।

মৎস্যমানবের দুঃখ: মৎস্যমানব মো. মিজানুর রহমান চৌধুরীর দুঃখ হলো, ২০০৫ সালে মাত্র ১৩.৩৭ সেকেন্ড ডুবে থেকে এক ব্রিটিশ নাগরিক গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে স্থান করে নিয়েছে। অথচ আমি ৭২ ঘণ্টা ডুবে থেকেও গিনেস বুক তো দূরের কথা আজ পর্যন্ত ভালোভাবে আমাদের দেশের মিডিয়ার দৃষ্টিও আকর্ষণ করতে পারলাম না। তিনি বলেন, এজন্য মিডিয়ার কোনো দোষ নেই। আমার প্রপার পৃষ্ঠপোষক না থাকার কারণেই আমি দেশবাসীর নজরে আসতে পারিনি। তিনি এক ডুবে ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার স্বপ্ন আর গিনেস বুকে নাম লেখানোর স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য সরকারের পাশাপাশি মিডিয়াকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

মানুষের আনন্দে মিজান আনন্দিত: নিঃসন্তান মৎস্যমানব মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমি পানিতে ডুবে থেকে মানুষকে আনন্দ দেই। আমার ডুবে থাকা দেখে মানুষ আনন্দ পায়, হাততালি দেয়, মুখে হাসির খই ফোটায়- এতেই আমি তৃপ্ত হই আনন্দিত হই। আমি আমার জীবনে অনেক কিছুই পেয়েছি। এ জীবনে এসে এখন একটাই আশা, জনগণের সেবা করা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থেকে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করে যাওয়া।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment