বাংলাদেশে যত রাজনৈতিক সংলাপ

দেশে রাজনৈতিক সংকট যখনই সৃষ্টি হয় তখনই বিভিন্ন পর্যায় থেকে সরকার ও বিরোধী পক্ষকে সংলাপের মাধ্যমে সংকট নিরসনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কখনও সরকারের পক্ষ থেকে আবার কখনও বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থেকে সংলাপের আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহুবার সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সংলাপ হয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব সংলাপ তেমন একটা ফলপ্রসূ হয়নি।

এতোদিন বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারকে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও সরকার সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু সর্বশেষ রবিবার দেশের সরকার বিরোধীজোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারকে আলোচনায় বসার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। আর সোমবার (২৯ অক্টোবর) সন্ধ্যায় সরকারের পক্ষ থেকে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনায় বসার বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমকে অবহিত করেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন অতীতে কী হয়েছে সেটা বিষয় নয়। এ রাজনৈতিক সংলাপ ফলপ্রসূ হোক সেটাই সকলের কাম্য।

বিভিন্ন সূত্র ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের লেখা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটময় মুহুর্তে সংলাপ হয়েছিল বিভিন্ন সময়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৯৭৬ সালের ২২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের বৈঠক হয়েছিল। এরপর ১৯৮৪ সালের ৯ এপ্রিল বঙ্গভবনে সাত দলের নেতাদের সঙ্গে সংলাপ করেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ। তখন সাত দলের পক্ষ থেকে ৩৩ দফা দাবিনামা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, সেই সংলাপ ফলপ্রসূ না হওয়ায় সাত দলের নেতারা সংলাপকক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসেন। পরদিন ১০ এপ্রিল বঙ্গভবনে জামায়াতের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এরশাদ। ১১ এপ্রিল ১৫ দলের নেতাদের সঙ্গে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি এরশাদের সংলাপ হয়েছিল। এর একদিন পর ১২ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি এরশাদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার একান্ত বৈঠক হয়। ১৪ এপ্রিল বঙ্গভবনে এরশাদের সঙ্গে ১৫ দলের দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠক হয়েছিল। ২৮ এপ্রিল বঙ্গভবনে আবারও আরও ১০ দলের সঙ্গে সংলাপ হয় এরশাদের। কিন্তু সেসব সংলাপ শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে বলে জানা যায়নি।

এরশাদ সরকারের সময়ে ১৯৮৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সংলাপের আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি এরশাদ। কিন্তু তখন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সেই সংলাপের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এর কিছুদিন পর ২৮ অক্টোবর তখনকার সরকারের দুই বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছিল। ওই বছরের ২৮ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি এরশাদ রাজনৈতিক সমস্যা নিরসনে আবারও আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধী রাজনীতিকদের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাননি।

১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর আবারও আওয়ামী লীগসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। পরবর্তীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে গেলে ১৯৯৪ সালের ৩১ আগস্ট রাজনৈতিক সংকট নিয়ে সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের দুই উপনেতার মধ্যে বৈঠক হয়েছিল। এছাড়া ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক সংকট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের বৈঠক হয়। উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয় সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে আলোচনার। তখনকার কমনওয়েলথ মহাসচিব এনিয়াওকুর এমেকা রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ওই বছরের ১৩ অক্টোবর ঢাকায় এসে দুই নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কমনওয়েলথ মহাসচিবের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক সংকট নিয়ে সংলাপে দুই নেত্রী আনুষ্ঠানিক সম্মতিও দিয়েছিলেন। পরে সেটিও সফল হয়নি। এমেকা খুব একটা আশার আলো দেখতে না পেয়ে পরে তারই বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ানকে পাঠিয়েছিলেন। যিনি বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক সংলাপ তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা করেছিলেন। নিনিয়ান একটি রাজনৈতিক ফর্মুলাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ফর্মুলা তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ মেনে না নেওয়ায় সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল।

১৯৯৫ সালে আবার বিরোধীদল সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছিল। ওই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দলের সেই সংলাপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তদানীন্তন শাসকদলীয় অন্যতম শীর্ষনেতা ও সংসদ উপনেতা বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন করলেও পরে আওয়ামী লীগসহ সরকার বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সরকার।

২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের সেটি প্রত্যাখ্যানের কারণে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। তখন সেই সংকট নিরসনে বাংলাদেশে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। তিনিও দুই পক্ষের সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন। কিন্তু তার চেষ্টাও ফলপ্রসূ হয়নি।

২০০৬ সালের অক্টোবরে তখনকার ক্ষমতাসীন দল বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মধ্যে প্রায় তিন সপ্তাহব্যাপী সংলাপ হয়েছিল নির্বাচনকালীন সরকারের ইস্যুতে। সেসময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ২৯ দফা তুলে ধরা হয়। ওই সময় মান্নান ভূঁইয়া ও আবদুল জলিলের মধ্যে ছয় দফা বৈঠক হলেও সমঝোতা হয়নি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের শেষ দিকে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে বসে বিএনপি। সংকট নিরসনে জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো তিনবার ঢাকায় এসেছিলেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি ৬ দিন ঢাকায় অবস্থান করে দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতা করার চেষ্টা করেন। আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে সরকার ও বিরোধী দলের বৈঠক হয়েছিল ১০ ও ১১ ডিসেম্বর। ওই দুই দিনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তারানকো। তৃতীয় বৈঠক হয় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি নিল ওয়াকারের উপস্থিতিতে। কিন্তু কোনও বৈঠকই সফল হয়নি।

সর্বশেষ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ সাত দফা দাবিতে সরকারকে আলোচনায় বসার জন্য রবিবার (২৯ অক্টোবর) চিঠি দেওয়া হয়। এরপর আজ (বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর) সকালে সংলাপে বসার সম্মতি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনকে চিঠি দেন। এতে আগামী বৃহস্পতিবার (১ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাতটায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

এ আলোচনা কতটুকু সফল হবে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আহমেদ কামাল বলেন, ‘অতীতে সফল হয়েছে কী হয়নি, সেই দিকে না তাকানোই ভালো। আমরা আশা করি যেকোনও সংকট আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা জরুরি। তাই এবারের সংলাপ বা আলোচনা ফলপ্রসূ হবে কি না সেই ভবিষ্যৎবাণী না করি। উভয়পক্ষ সংলাপে বসছে। আলোচনা হোক। সফল হোক সেটাই আমরা চাই।’

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment