মাঠে ফিরে দুঃখ ঘোচাতে চান চামেলি

মাঠে ফিরে দুঃখ ঘোচাতে চান চামেলি

২০১১ সালে বিশ্বকাপ মিশন শেষ হয়েছে। ছুটি দু’সপ্তাহ। তবুও বাড়ি ফিরেননি। নিজেকে আরো ক্ষুরধার করতে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের মাঠে প্রতিদিন অনুশীলনে নামেন।

কিন্তু, বুঝতে পারেননি ক্রমশই তার খেলার জগৎটা ছোট হয়ে আসছে। দিন তারিখ ঠিক মনে নেই। ছেলেদের সাথেই বিকেলে ফিল্ডিং চর্চা করছিলেন। এমন সময় রিকশার চাকা ফেটে যাবার মতো আওয়াজ হতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ছিড়ে যায় তার ডান পায়ের লিগামেন্ট। সতীর্থরা ধরাধরি করে নিয়ে যান। কিন্তু, বিষয়টি কাউকে বুঝতে না দিয়ে ছুটি শেষে আবারো ফিরে যান জাতীয় দলের অনুশীলনে। তবে আগের মতো কিছুই করতে পারেন না।

ফিল্ডিং করার সময় এমনিতে ডান পা ঘুরে যায়। লক্ষ্য করেন দলের অনুশীলনের দায়িত্বে থাকা মাঠের কর্মকর্তারা। প্রশ্ন উত্থাপিত হলে বিষয়টি জানান। কিন্তু, কেউ তেমনভাবে গুরুত্ব দেননি। শেষ হয়ে যায় ক্রিকেট খেলা। এই গল্প বাংলাদেশ প্রমীলা ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় চামেলি খাতুনের।

লিগামেন্ট ছিড়ে যাওয়াসহ মেরুদণ্ডে হাড়ের ব্যথা নিয়ে দু’সপ্তাহের অধিক সময় ধরে রাজশাহী মহানগরীর দরগাপাড়া এলাকার নিজ বাসভবনে বিছানায় পড়ে থাকেন তিনি। মেরুদণ্ডে দুই হাড়ের ফাঁকে থাকা নরম ডিস্কগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অবশ হয়ে যাচ্ছে তার পুরো ডান পাশ। স্বাভাবিক চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়।

তার এই অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়সহ শুভাকাঙ্ক্ষিরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। হাত বাড়িয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।

সেই নির্দেশনায় শুক্রবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে নভোএয়ারের একটি ফ্লাইটে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা নেয়া হয় চামেলিকে। ভর্তি করা হয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (ঢাকা পঙ্গু হাসপাতাল)।

শুরু হয় চিকিৎসা কার্যক্রম। শনিবার তার বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। রোববার রিপোর্ট পাবার পর হাসপাতালের পরিচালকের নেতৃত্বে বোর্ড গঠন করে মিটিংয়ের মাধ্যমে চামেলির সুষ্ঠু চিকিৎসার ব্যাপারে সার্বিক সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা রয়েছে। এই চিকিৎসকদের বোর্ডে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও বাংলাদেশ আনসার বাহিনীর চিকিৎসক থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

দুপুরের দিকে এই বোর্ড মিটিং হতে পারে বলে জানিয়েছেন আলরাউন্ডার এই ক্রিকেটারের সঙ্গে থাকা তার দুলা ভাই রাজু আহম্মেদ। হাসপাতালে তার সঙ্গে আরও আছেন মেজো বোন চম্পা খাতুন ও ভাবি শাহনাজ বেগম।

চামেলির বরাত দিয়ে তার দুলা ভাই পরিবর্তন ডটকমকে জানান, পঙ্গু হাসপাতালের ডাক্তাররা প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন দেশেই তার চিকিৎসা সম্ভব। কিন্তু, চামেলি জাতীয় দলের অন্যান্য খেলোয়াড়দের মতোই বিদেশে চিকিৎসা করাতে আগ্রহী।

রাজশাহী মহানগরীর দরগাপাড়া এলাকায় অলরাউন্ডার ক্রিকেটার চামেলি খাতুনের বাড়ি। পৌনে এক কাঠা জমির উপর জরাজীর্ণ টালির ছাদের দুই ঘর বিশিষ্ট বাড়িতে থাকেন তার বৃদ্ধ বাবা রোস্তম আলী, বৃদ্ধা মা মোনোয়ারা বেগম, বড় বোন চম্পা খাতুন। বিয়ে না হওয়ার কারণে চম্পাও বাড়িতে থাকেন। ছয় বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে চামেলি সবার ছোট। চারজনের এই সংসার চলে চামেলির উপার্জনে।

তিনি খেলোয়াড় হিসেবেই আনসার বাহিনীতে কর্মরত। অসুস্থ হলেও সংসারের খরচ জোগাতে চাকরিটি চালিয়ে যাচ্ছিলেন চামেলি। তিনি চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছেন।

বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের হয়ে ১৯৯৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত মাঠ মাতিয়ে বেড়িয়েছেন চামেলি খাতুন। ২০১০ সালের এশিয়া কাপের রানার আপ হওয়া দলের হয়ে মাঠ মাতান এই দাপুটে ক্রিকেটার।

এর বাইরে ঢাকা বিভাগে খেলেছেন টানা। দুই মৌসুম শেখ জামালের ক্যাপ্টেন হিসেবে সামনে থেকে টেনে নিয়ে গেছেন দলকে। এখন তিনিই পরাস্ত ইনজুরিতে।

অলরাউন্ডার চামেলি বলেন, প্রায় আট বছর আগে জিম করার সময় মাজায় ব্যথা পান। এরপর থেকে মাঝেমধ্যেই সে ব্যথা অনুভব করতেন। ওষুধ খেয়ে ব্যথা নিয়ন্ত্রণ করে আনসারের চাকরি করতেন। দেড় বছর আগে ঢাকা থেকে বদলি নিয়ে রাজশাহী চলে এসেছেন।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাজশাহী আনসার অফিসে কাজ করার সময় ডান হাত ও পায়ে কাঁপুনি উঠে পড়ে যান। সেখান থেকে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেটিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক মুনজুর রহমান তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্যবস্থাপত্র দেন। তাতে অতি সত্ত্বর দেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে সার্জারির পরামর্শ দেন চিকিৎসক।

তবে ওষুধ খাওয়ার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে তিন দিন পর থেকে আবার অফিস করেন। গত ৩ অক্টোবর অফিসে কাজ করার সময় আবার পড়ে যান। এরপর থেকে তার ঠাঁই হয় বিছানায়। ক্রমশই তার ডান পাশ অবশ হতে থাকে।

তিনি জানান, অন ডে স্ট্যাটাস সামনে রেখে দলের প্রস্তুতি চলছিল ২০১১ সালে। ফিল্ডিং প্রশিক্ষণ চলাকালীন পড়ে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে আবাহনী ক্রীড়া চক্র মাঠে প্রশিক্ষণে গিয়েও আরেক দফা আঘাত পান। কিন্তু কখনোই যথাযথ চিকিৎসা নেননি।

এই ইনজুরি তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার খাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়েছে। পরিবারের হাল ধরতে গিয়ে নিজের চিকিৎসা করাতে পারেননি।

চামেলি আনসার বাহিনীর নারী সদস্য। কর্মস্থলেই অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। মাঝে রাজশাহীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। পরীক্ষায় সেখানেই ধরা পড়ে এই অসুস্থতা।

দীর্ঘ আট বছর খেলার মাঠ থেকে বাইরে তিনি। এরই মধ্যে আনসার বাহিনী তাকে চিকিৎসাজনিত ছুটি দিয়েছে। সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন বাহিনীর সদস্যরা।

তাছাড়াও জাতীয় দলের সাকিব, মুস্তাফিজ, রুবেল, মুশফিকসহ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও বিভিন্ন স্তরের শুভাকাঙ্খীরা তার চিকিৎসার জন্য এগিয়ে এসেছেন। সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সার্বিক চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়ায় তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন চামেলি।

তিনি আশা করেন, সুষ্ঠু চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে আগামীতে আবারো মাঠে ফিরতে পারবেন এবং দেশের হয়ে ভালো কিছু করবেন।

চামেলির মা মনোয়ারা বেগম বলেন, চামেলি তাদের পরিবারের একমাত্র আয়ের ভরসা। তার উপর ভর করে আছে পুরো সংসর। তারা স্বামী-স্ত্রী দুইজনেই অসুস্থ। প্রতি সপ্তাহে তার নিজের ৬০০ টাকার ওষুধ লাগে। যা ব্যবস্থা মেয়ে চামেলি করে দেয়।

তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তার মেয়ের পুরো চিকিৎসা ভার নেবার জন্য। আশা করেন সুস্থ হয়ে তার মেয়ে আবারো দেশের হয়ে খেলতে পারবেন।

বাবা রস্তুম আলী প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি যারা চামেলির চিকিৎসায় সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেটিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক মুনজুর রহমান বলেন, লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়াসহ মেরুদণ্ডে হাড়ের ব্যথা রয়েছে চামেলির। মেরুদণ্ডে দুই হাড়ের ফাঁকে থাকা নরম ডিস্কগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অবশ হয়ে যাচ্ছে তার পুরো ডান পাশ। দ্রুত তার মেরুদণ্ডে সার্জারি করার জন্য প্রায় এক মাস আগে তাকে ভারতে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment