নানা প্রতিশ্রুতি, পাল্লাপাল্টি অভিযোগ, কাশ্মীর নিয়ে চলমান উত্তেজনা এবং শেষ মুহূর্তে মাওবাদীদের হামলায় বিধায়কের মৃত্যুর মত সব ঘটন অঘটন শেষে এবার ভোটের জন্য প্রস্তুত ভারত। রাত পোহালেই শুরু হবে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের ভোটযুদ্ধ।
ভোটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরাতন দল কংগ্রেস পার্টির মূল লড়াই হবে বলেই ধারণা। তবে বিভিন্ন প্রভাবশালী আঞ্চলিক দলগুলোও ভোটের মোড় ঘুরিতে দিতে সক্ষম।
বিভিন্ন জনমত জরিপ ভোটযুদ্ধে মোদীর দলের এগিয়ে থাকারই আভাস দিচ্ছে। গত ১০ মার্চ ভারতের নির্বাচনী তফিসিল ঘোষণা করা হয়। দেশটিতে প্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে মোট সাত দফায় ভোট গ্রহণ হবে।
বৃহস্পতিবার হবে প্রথম দফা ভোট। এদিন ১৮টি রাজ্যের মোট ৯১টি আসনে ভোট হবে। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলবে। এই ৯১টি আসনে প্রায় ১৩শ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দিতা করছেন।
এছাড়া আগামী ১৮ এপ্রিল, ২৩ এপ্রিল, ২৯ এপ্রিল, ৬ মে, ১২ মে এবং সবশেষে ১৯ মে ভোট হবে। আগামী ২৩ মে ভোট গণনার পর ওই দিনই ফলাফল ঘোষণার কথা রয়েছে।
ভারতের পার্লামেন্টের নিম্মকক্ষ লোকসভার মোট আসন সংখ্যা ৫৪৫ হলেও নির্বাচন হয় ৫৪৩টি আসনে। বাকি দুটি আসন ভারতের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত৷ তাদের দুই প্রতিনিধি কে হবেন, তা ঠিক করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি৷
সরকার গঠনের জন্য কোনো দল বা জোটকে অন্তত ২৭২টি আসন পেতে হবে। বর্তমান লোকসভার মেয়াদ আগামী ৩ জুন শেষ হচ্ছে।
গতবার বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ ৩৩৬টিতে জয়লাভ করেছিল। যার মধ্যে একা বিজেপি ২৮২টি আসনে জিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কংগ্রেস জিতেছিল মাত্র ৪৪টি আসনে। ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬৬ শতাংশের বেশি।
এক নজরে ভোট
>> ভোটার: প্রায় ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে এবার ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি। যা সমগ্র ইউরোপ ও ব্রাজিলের মোট জনসংখ্যার কাছাকাছি। এর মধ্যে নারী ভোটারের সংখ্যা ৪৩ কোটি ২০ লাখ। দেশটিতে ১৮ বা তার চেয়ে বেশি বয়সের নাগরিকরা ভোটার হতে পারেন।
সর্বশেষ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিবন্ধিত ভোটারের সংখ্যা ছিল ৮৩ কোটি। সেবার মোট ভোটারের ৬৬ শতাংশ, অর্থাৎ ৫৫ কোটি ৩০ লাখ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন।
>> ভোটের সময়: ভোটের দিন সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র খোলা থাকবে।
>> কেন্দ্র ও ভোটকক্ষ: এবারের লোকসভা নির্বাচনের জন্য প্রায় ১০ লাখ ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে; গত বারের তুলনায় যা ১০ শতাংশ বেশি। কোনো কেন্দ্রই যেন ভোটারদের থেকে দুই কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে না থাকে, এই নির্দেশনা মেনেই এবার এতগুলো কেন্দ্র বসানো হচ্ছে।
নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য কর্মকর্তারা পায়ে হেঁটে, সড়কপথে, বিশেষ ট্রেন, হেলিকপ্টার, নৌকা এমনকী কখনো কখনো হাতির পিঠে চেপে কেন্দ্রে যান।
>> প্রতিদ্বন্দ্বী: ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রতিটি সংসদীয় আসনে গড়ে ১৫ জন করে প্রার্থী ছিলেন বলে ইসিআইয়ের তথ্যে জানা গেছে। এর মধ্যে একটি আসনে ছিল সর্বাধিক ৪২ জন প্রার্থী। গতবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ৮ হাজার ২৫১ প্রার্থীর মধ্যে নারী ছিলেন মাত্র ৬৬৮ জন। এবারও প্রায় একই চিত্র দেখা যাবে।
সর্বশেষ ওই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নিকটতম প্রার্থীকে ৫ লাখ ৭০ হাজার ১২৮ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছিলেন তিনি।
ভোটের ব্যয়
ভারতীয় একটি সংস্থার হিসেবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রায় ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় হয়েছিল। দেশটিতে নির্বাচনের অংশ নেয়া দলগুলোকে তাদের আয়ের উৎস প্রকাশ করতে হয়।
গত বছর মোদী সরকার নির্বাচনী বন্ড ছাড়ে যা ব্যবসায়ী ও অন্য ব্যক্তিদের পরিচয় গোপন রেখে চাঁদা দেয়ার সুযোগ করে দেয়।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দাতারা ইতোমধ্যেই ১৫ কোটি মার্কিন ডলার এই বন্ডের মাধ্যমে দিয়েছে। যার সিংহভাগই গেছে বিজেপি’র কাছে।
নারী ভোটার
২০১৪ সালের নির্বাচনে নারী ও পুরুষের ভোটারের ব্যবধান ছিলো খুব কম। নারীদের ভোট দেয়ার হার ছিল ৬৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আর পুরুষের ছিলো ৬৭ দশমিক ১ শতাংশ।
এবারের নির্বাচনেও প্রধান দলগুলো নারী ভোটারদের কথা মাথায় রেখে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিজেপি-কংগ্রেস উভয় দলই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে নারীদের জন্য লোকসভা ও বিধানসভায় ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের কথা বলেছেন।
নরেন্দ্র মোদী
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বেই বিজেপি ২৮২টি আসনে জিতে নির্বাচনে বিশাল জয় পেয়েছিল। সেটিই ছিল প্রথমবারের মতো বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
এ বিশাল জয়ের কৃতিত্ব পুরোপুরি মোদীর। যিনি একজন পরিশ্রমী নেতা হিসেবে দলে দারুণ জনপ্রিয়। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহসহ বেশির ভাগ নেতা তার প্রতি বিশ্বস্ত।
যদিও মোদীর হিন্দুত্ববাদ ইমেজ এবং গত মেয়াদে দেওয়া অনেক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করায় কিছুটা অসুবিধার মধ্যে আছেন। তার পরও মোদীই বিজেপির তুরুপের তাস। বিরোধী পক্ষেরও টার্গেট তাই মোদী।
অর্থনীতিই মূল বিষয়?
মোদী সরকারের সময়ে এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটি কিছুটা গতি হারিয়েছে। শস্যের দাম পড়ে যাওয়ার কৃষকরাও দারুণ ক্ষুব্ধ। মোদীর আমলে একাধিকবার বড় আকারে কৃষক বিক্ষোভ হয়েছে।
এছাড়া, ২০১৬ সালের নোট নিষিদ্ধের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত আর সার্ভিস ট্যাক্স ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছে। ভাটা এসেছে রপ্তানি আয়েও, বেড়েছে বেকারত্ব। কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ঋণের দায়ে ডুবতে বসেছে।
এর উত্তরে নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, অর্থনীতিতে সংস্কারের কাজ চলছে।