যৌন হয়রানি বিচারে আইন হয়নি

কর্মস্থলে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহকর্মী বা সহপাঠীর কটূক্তির শিকার অহরহ হচ্ছেন নারী। অনেকেই অনাকাক্সিক্ষত এ ঘটনা চেপে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই প্রতিবাদও করছেন। তীব্র মানসিক যন্ত্রণা সইতে না পেরে কেউ আবার মৃত্যুকে বেছে নিচ্ছেন। এ ধরনের কর্মকাণ্ড বা অপরাধকে ‘যৌন হয়রানি’ শব্দ দ্বারা চিহ্নিত করা হলেও আইনে যৌন হয়রানি শব্দের উল্লেখ নেই। সম্প্রতি অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানের ঘটনাও সেই যৌন হয়রানিকে কেন্দ্র করেই ঘটে।

দেশে যৌন হয়রানি রোধে কোনো আইন এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০০৯ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি রোধে একটি নীতিমালা করে দেন। আইন তৈরি না হওয়া পর্যন্ত ওই নীতিমালা অনুসরণ করতে বলা হয়। কিন্তু সেই নীতিমালারও কোনো প্রয়োগ নেই। আবার ওই রায়ের আলোকে আইন কমিশন থেকে ২০১০ সালে একটি আইন তৈরির জন্য সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সেই সুপারিশও আমলে নেওয়া হয়নি।
সরকার তৎপর না হলে যৌন হয়রানি কমবে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভানেত্রী অ্যাডভোকেট ফৌজিয়া করিম ফিরোজ। তিনি যৌন হয়রানি রোধে ২০০৯ সালে হাইকোর্ট নীতিমালা করে যে রায় দিয়েছেন, সেই মামলার আইনজীবী ছিলেন।

জানতে চাইলে ফৌজিয়া করিম ফিরোজ আমাদের সময়কে বলেন, ‘২০০৯ সালে যৌন হয়রানি রোধে যে রায় হাইকোর্ট দেন, তার সব বিবাদী সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো। সরকারের সচিবদের ওপর নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু তারা সেটা করছে না। আজ পর্যন্ত ওই রায় বাস্তবায়নে কিছুই করেনি। রায় বাস্তবায়নের দায়বদ্ধতা সরকারের। তারা রায় বাস্তবায়ন করলে মানুষ সচেতন হতো। ওই রায়ে যৌন হয়রানির সংজ্ঞা দেওয়া আছে।

দেওয়াল লিখনে কেউ যদি নাম-ছবি দিয়ে কাউকে হয়রানিমূলক বক্তব্য লিখে হেয় করে, তা হলে সেটাও যৌন হয়রানির মধ্যে পড়বে। ইশারা-ইঙ্গিতে কাউকে যৌন উত্তেজনামূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা-উপহাসও যৌন হয়রানি। এতকিছু থাকার পরও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ কারণে যৌন হয়রানি বেড়েই চলেছে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু এ নীতিমালা কার্যকর হয়নি, তাই একটি আইন করতে আমরা তৎপর। এ আইনের একটা খসড়া করেছি। সেটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এ বিষয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। আইন করা নিয়ে আলোচনা চলছে।

নীতিমালায় যা ছিল : ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারিসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নীতিমালা (গাইডলাইন) জারি করেন। হাইকোর্টের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র বা রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলে তা খতিয়ে দেখতে কর্তৃপক্ষকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। এ অভিযোগ গ্রহণে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি করে অভিযোগকেন্দ্র স্থাপন এবং অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্যাতিত ও অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় গোপন রাখতে বলা হয়। অভিযোগকেন্দ্র গঠনের ব্যাপারে রায়ে বলা হয়, একজন নারীকে প্রধান করে অন্তত ৫ সদস্যের একটি অভিযোগকেন্দ্র গঠন করতে হবে। এ ছাড়া কমিটিতে একাধিক নারী সদস্য থাকবেন। কমিটির দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদন দেখে প্রচলিত আইন অনুযায়ী আদালত ব্যবস্থা নেবেন।

নীতিমালার ৪ নম্বর ধারায় যৌন হয়রানির সংজ্ঞা তুলে ধরা হয়। ওই ধারা অনুসারে, যৌন হয়রানি বলতে-ক. অনাকাক্সিক্ষত যৌন আবেদনমূলক আচরণ (সরাসরি কিংবা ইঙ্গিতে) যেমন: শারীরিক স্পর্শ বা এ ধরনের প্রচেষ্টা; খ. প্রাতিষ্ঠানিক এবং পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা; গ. যৌন হয়রানি বা নিপীড়নমূলক উক্তি; ঘ. যৌন সুযোগ লাভের জন্য অবৈধ আবেদন; ঙ. পর্নোগ্রাফি দেখানো; চ. যৌন আবেদনমূলক মন্তব্য বা ভঙ্গি; ছ. অশালীন ভঙ্গি, অশালীন ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা, কাউকে অনুসরণ করা বা অশালীন উদ্দেশ্য পূরণে ব্যক্তির অলক্ষ্যে তার নিকটবর্তী হওয়া বা অনুসরণ, যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা বা উপহাস;

জ. চিঠি, টেলিফোন, মোবাইল, এসএমএস, ছবি, নোটিশ, কার্টুন, বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল, নোটিশ বোর্ড, অফিস, ফ্যাক্টরি, শ্রেণিকক্ষ, বাথরুমের দেয়ালে যৌন ইঙ্গিতমূলক অপমানজনক কোনো কিছু লেখা; ঝ. ব্ল্যাকমেইল অথবা চরিত্র লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে স্থির বা ভিডিওচিত্র ধারণ; ঞ. যৌন হয়রানির কারণে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং শিক্ষাগত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হওয়া; ট. প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হুমকি দেওয়া বা চাপ প্রয়োগ করা; ঠ. ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনের চেষ্টা করা।

রায়ে নীতিমালা প্রণয়নের তিনটি উদ্দেশ্য তুলে ধরে বলা হয়-যৌন হয়রানি, যৌন অপরাধের ফল এবং যৌন হয়রানি যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সে ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করাই এ নীতিমালার উদ্দেশ্য। যত দিন পর্যন্ত যৌন হয়রানি রোধ ও তা প্রতিকারের জন্য জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়ন করা না হবে, তত দিন পর্যন্ত সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টের দেওয়া এ নীতিমালা বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর করতে বলা হয় রায়ে।

নীতিমালার আলোকে প্রণীত হয়নি আইন : ২০০৯ সালে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে সংসদকে আইন প্রণয়নের জন্য বলা হয়। এর পর ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট আইন কমিশন যৌন হয়রানির একটি খসড়া আইন তৈরি করে। ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন, ২০১০ (প্রস্তাবিত খসড়া)’ নামের আইনটিতে মোট ২১টি ধারা রয়েছে। এ ছাড়া লঘু ও গুরুতর অপরাধ আলাদাভাবে চিহ্নিত করে একটি তফসিল সংযুক্ত করা হয়।

কিন্তু এ আইন এখনো আলোর মুখ দেখেনি। সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতীয় মহিলা আইনজীবী পরিষদসহ ১৭টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম’ এ আইনের বিষয়ে মতামত ও খসড়া অনুলিপি আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। এ ছাড়া কয়েকটি নারী সংগঠনও এ সংক্রান্ত খসড়া উপস্থাপন করেছে। কিন্তু আইনটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। সংগঠনগুলো যৌন হয়রানি রোধে এখন আইন তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করছে।

বাস্তব অবস্থা হতাশাজনক : বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনা কতটা প্রয়োগ হচ্ছে, তা নিয়ে সম্প্রতি এক গবেষণা পরিচালনা করে ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা অ্যাকশনএইড। ওই গবেষণাকর্মের ফল গত ১৭ জানুয়ারি প্রকাশ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়, করপোরেট খাত, মিডিয়াসহ পাঁচটি খাতের ২১টি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং ব্যবস্থাপকদের মধ্যে গবেষণাটি চালানো হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনার ৯ বছর পরও প্রতিষ্ঠানগুলো যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ওই নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।

গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৭ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালের সুপ্রিমকোর্টের দিকনির্দেশনা সম্পর্কে একেবারেই অবগত নয়, কর্মক্ষেত্রে যার হার ৬৪.৫ শতাংশ। অথচ হাইকোর্টের দেওয়া গাইডলাইনের তিন উদ্দেশ্য তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে প্রথমটি ছিলÑ যৌন হয়রানি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি। দ্বিতীয়টি ছিল যৌন অপরাধের ফল সম্পর্কে সচেতন এবং তৃতীয়ত যৌন হয়রানি যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সে ব্যাপারে সচেতন করা।

অ্যাকশনএইডের গবেষণাটির তত্ত্বাবধায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন জানান, ‘প্রতিষ্ঠানগুলোয় ২০০৯ সালের গাইডলাইনের প্রয়োগ একেবারে নেই বললেই চলে। যেখানে আছে সেখানে সীমিতভাবে প্রয়োগ হচ্ছে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একেবারেই নেই, এবং শুধু যে নেই তা নয়, যাদের সেটা প্রয়োগ করার কথা তারা অনেকে এ গাইডলাইন সম্বন্ধে জানেনই না।’

তাসলিমা ইয়াসমিন আরও জানান, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে গাইডলাইন প্রয়োগ হয়েছে, সে ধরনের একটা কমিটিও করা হয়েছে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীর তুলনায় অভিযোগের সংখ্যা একদমই সমানুপাতিক নয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সীমিতসংখ্যককে এ ধরনের যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্ত কমিটি আছে। কিন্তু দু-একটি ছাড়া বাকিগুলো একেবারেই অকার্যকর। বাংলাদেশে নারী কর্মসংস্থানের একটি বড় অংশ তৈরি পোশাক শিল্পে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এ চিত্রটি আরও খারাপ বলে জানান এ শিক্ষক। তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্রে আমরা দেখলাম, রাইট-বেজড দু-একটি এনজিওর কেউই ২০০৯ সালের নীতিমালার বাস্তবায়ন করেনি। এর কারণ সম্পর্কে আমরা জেনেছি যাদের এ গাইডলাইনটি প্রয়োগ করার কথা, তারা কিন্তু এই গাইডলাইনের বিষয়ে জানেনই না।’

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment