মেয়েরাও গায়ে পড়বেন না, প্লিজ!

আমিও মেয়েদের বলতে চাই- আপু, গায়ে পড়বেন না প্লিজ। সরে দাঁড়ান। কোনো রাখঢাক না করে, খুব স্পষ্ট ভাবে, সামাজিক গোপনীয়তা ভেঙে এ সত্যটি আমিও প্রকাশ্যে বলতে চাই। বলতে চাই, মেয়েরাও পুরুষদের গা ঘেঁষে, গায়ে পড়ে, অশ্লীল ইঙ্গিত করে, কুপ্রস্তাব দেয়, যৌন হয়রানি করে- এমন মেয়েদের সংখ্যাও কম নয়।

আমাদের একধরনের দৃষ্টি ত্রুটি রয়েছে। আমরা পুরো চিত্রটি একবারে দেখতে পারি না, দেখতে চাই না। দেখি খণ্ড খণ্ড ভাবে। খণ্ডিত আকারে। সোসাইটি যে ভেতরে ভেতরে অনেক দূর বদলে গেছে, টের পাই না। কার্পেট পরিষ্কার করি নিচের ধুলো রেখে। আমরা কেবল ইভটিজিং ইভটিজিং করছি। অ্যাডাম টিজিংও যে বেড়ে গেছে, ভেতরে ভেতরে, তলে তলে সে খবর কে রাখে?

`পরিচয়ের এক দু’দিনের মধ্যেই টান-প্রেম-ভালোবাসার বাম্পার ফলন। ‘জান-জানু-বাবু-সোনা’- এমন আবেগী আহ্লাদী স্বরে সুরে ডাকতে ডাকতেই হঠাৎ করে টাকা ধার চেয়ে বসে মেয়েটি। ভালো একটি এমাউন্ট। দিতে পারলে আছো, না দিতে পারলে নেই। নো রিলেশন ইউথ ইউ। প্রতারিত হয় ছেলেটি।‘

বাংলাদেশে টি-শার্টে আন্দোলন হচ্ছে। মেয়েরা টি-শার্ট পরে নেমেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি দিচ্ছে- গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না। বড় একচোখা, একরোখা, এক পাক্ষিক আন্দোলন। খুব বাহাবা পাচ্ছে। বাহাবা দিচ্ছেন অনেকে। ‘তথাকথিত প্রগতিশীল’, ‘তথাকথিত নারীবাদীরা’ উস্কে দিচ্ছেন কেউ কেউ। যে গতিশীলতা সবাইকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় না, তা কি কখনও প্রগতিশীলতা? পুরুষও যে বিব্রত হয়, সংকোচবোধ করে, অসম্মানিতবোধ করে নারীর অসভ্য আচরণে, কে বলবে সে কথা?

আমি তো মনে করি, সময় এসেছে পুরুষদেরও টি-শার্ট পরে নামার, বুকে পিঠে লিখে ‘সড়ে দাঁড়ান’। অথবা ‘গায়ে পড়বেন না প্লিজ’। রাস্তায়, বাসে, পার্কে, শপিংমলে, রেস্টুরেন্টে, থিয়েটার হলে, পার্টিতে, অফিসে গা ঘেঁষা, গায়ে পড়া মেয়েদের অভাব নেই। কিছু কিছু মেয়েরা তো রীতিমতো ‘ছেলেধরা’। এরা কোনও না কোনও ভাবে ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে মরিয়া।

এক্সকিউজ মি, আপনার নাম্বারটা হবে? এমনি মাঝে মাঝে কথা বলবো। ডিস্টার্ব করবো না, প্লিজজজজ! ক’দিন পরে আরেক সম্পর্ক, আবার সম্পর্ক। একই কায়দায়। ইদানিং আরেকটা টাইপ বা ধরনের উত্থান ঘটেছে। পরিচয়ের এক দু’দিনের মধ্যেই টান-প্রেম-ভালোবাসার বাম্পার ফলন। ‘জান-জানু-বাবু-সোনা’- এমন আবেগী আহ্লাদী স্বরে সুরে ডাকতে ডাকতেই হঠাৎ করে টাকা ধার চেয়ে বসে মেয়েটি। ভালো একটি এমাউন্ট। দিতে পারলে আছো, না দিতে পারলে নেই। নো রিলেশন ইউথ ইউ। প্রতারিত হয় ছেলেটি।

আমি সুদর্শন সন্দেহ নেই কোনো। লক্ষ্য করেছি, নানা ছুঁতোয়, নারীরা আমাকে ‘নক’ করেন। ‘নক’ যে কেউ আমাকে করতে পারেন, আপত্তি নেই। তবে কখনও কখনও তা শালীনতার মাত্রাকে ছাড়িয়ে চলে যায় বহুদূর। কখনও তা রীতিমত অশ্লীল। আমার ম্যাসেঞ্জার ভরে আছে অসংখ্য নারীদের ইশারা, ইঙ্গিত আর প্রস্তাবে।

কারো শুধু টেক্সট, কারো বা ছবি। কেউ প্রেম করতে চান, কেউবা ডিরেক্ট- শোবে, শোবো। কারো স্তনের ছবি, কারো বা উরুসন্ধির। ভিডিওকলের জন্য মরিয়া, এমন মেয়েদেরও তো ছড়াছড়ি। এদের দিন নেই, রাত নেই। কল দিয়ে বসেন যখন তখনই। কেউ কেউতো রীতিমত ক্রেজি। কেন সাড়া দেই না, কেন অপরিচিত নারীদের যৌন প্রস্তাব লুফে নেই না- ভীষণ আপত্তি। ‘কেমন পুরুষ আপনি, নাড়া দেই সাড়া দেন না, আপনি কি সমকামী’?

যৌন প্রস্তাবে সাড়া না দেয়া অপরিচিত নারীদের এমন সব অশ্লীল মন্তব্যতে অভ্যস্ত আমি। এদেশে আমার চেয়েও সুদর্শন, শতগুণ হ্যান্ডসাম পুরুষের অভাব নেই। তার মানে আরও অসংখ্য পুরুষ প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত এমন অচেনা অজানা নারীদের যৌন ইঙ্গিতের, যৌন হয়রানির শিকার প্রতিদিনই। যেভাবে ভিকটিম আমি।

সোসাইটালি আমাদের ‘পুরুষ’ কনসেপ্টটিতে ঝামেলা রয়েছে। রয়েছে প্রচুর ভুল ও বিভ্রান্তি। পুরুষকে কি কম যৌনবস্তু হিসেবে দেখা হয়? পুরুষের ছোট-বড়, কতক্ষণ পারে কি পারে না- এসব কি পুরুষকে যৌনবস্তুতে পরিণত করে না? সন্তান উৎপাদনে বিলম্ব বা অনাগ্রহে তাকে ‘নপুংসক’ বলে কুৎসিত মন্তব্য শুনতে হয়। পুরুষের পরিচয় কি তার ‘করা’ আর ‘পারায়’? পুুরুষ কোন যৌনবস্তু নয়, যৌনযন্ত্রও নয় সে। পুরুষের যে ‘মাচো’ ইমেজ তার পুরোটাই তো পুরুষতান্ত্রিকতার ফল ও ফসল।

মানুষকে মানুষ ভাবতে হবে, হতে হবে মানবিক। আন্দোলনও হতে হবে ‘সামগ্রিক’। সবার জন্য। নারীকে পুরুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিলেই মুক্তি মিলবে- অমন নয়। ভুলে গেলে চলবে না, এই উপমহাদেশে নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধে, সতীদাহ প্রথা, বিধবা বিবাহের জন্য পুরুষেরাই ভূমিকা রেখেছিল। রাজা রামমোহন রায় আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তো পুরুষই ছিলেন। তারা দাঁড়িয়েছিলেন মানবতার জন্য, নারীর পক্ষে।

দাঁড়াতে হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অন্যায্যের বিরুদ্ধে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে, যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে। নারী বা পুরুষের বিরুদ্ধে নয়। নারী বা পুরুষ ফ্যাক্টর নয়, ফ্যাক্টর অন্যায়, অসভ্য আচরণ- সে নারীই করুক বা পুরুষই হোক। কেউই কারো গা ঘেঁষে দাঁড়াবে না, অসভ্যভাবে, অন্যায়ভাবে। অশ্লীল ইঙ্গিত, যৌন প্রস্তাবের জন্য যদি পুরুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাই, বিচার চাই, তবে নারীকেও দাঁড় করাতে হবে।

অশ্লীলতা, অসভ্যতার জন্য নারীরও বিচার করতে হবে। তবেই সমতা, সমানাধিকার, নয়তো নয়!

লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment