কৃষকদের লোকসান, মিলাররা লাভবান

স্টাফ রিপোর্টার, নওগাঁঃ

নওগাঁয় ৫ লাখ কৃষি কার্ডধারীর বিপরীতে চলতি ইরি-বোরোমৌমুসে মাত্র ৫ হাজার ৬শ’ ৩২ মেট্রিকটন ধান কেনার ঘোষণা দিয়েছে। অপরদিকে চাতালমালিকদের কাছ থেকে জেলার প্রায় ১২শ’ চাতাল মালিকদের কাছ থেকে ৭২ হাজার মেট্রিকটনচাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সারাদেশে চাতাল মালিকদের কাছে থেকে ১২ লাখমেট্রিকটন চাল ও কৃষকদের কাছ থেকে ১ লাখ মেট্রিকটন ধান সংগ্রহ ঘোষণা দেয়ার ২০দিন পর সংগ্রহ শুরু করা হয়েছে। এতে নওগাঁয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেয়া দিয়েছে কৃষক ওকৃষকদের ধানের নায্য দাম পাওয়ার দাবিতে আন্দোলনদের মধ্যে। তারা দাবি করেন, নওগাঁয় ৮০ভাগ কৃষক। অথচ নওগাঁয় মাত্র ৫ হাজার ৬শ’ ৩২ মেট্রিকটন ধান কেনার ঘোষণা দিয়েছে।এতে কৃষকরা তাদের ধানের নায্য মূল্য না পাওয়ায় লোকসান গুণতে হচ্ছে।সরকারের এইঘোষণাকে ‘কৃষকবান্ধব’ না বলে ‘চাতাল মালিক বান্ধব’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।কৃষকদের লোকসান ঠেকাতে ইউনিয়ন পর্যায় সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনারদাবি জানানো হয়েছে। দ্রুত নায্য মূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার দাবি জানানোহয়েছে।নওগাঁ কৃষি বিভাগ ও খাদ্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলা নওগাঁ। চলতিবছরে ইরি-বোরো ধান প্রায় ১ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে।

 ধান ও চালসংগ্রহ করা হয় ২৫ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট। গত ২৫ আগষ্ট ধান ও চাল সরকারি গুদামেসংগ্রহ শুরু হওয়ায় ঘোষণা থাকলেও নির্ধারিত দিনের ২০ দিন পর ১৫ মে খাদ্য মন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার এমপি প্রধান অতিথি থেকে নওগাঁয় সদর খাদ্য গুদামে এই সংগ্রহকর্মসূচীর উদ্বোধন করেন।কৃষকরা জানিয়েছেন, ইরি-বোরো ধান লাগানো শুরু ধান চাষের অনুকূলে থাকলেও পরবর্তীতেধান বড় হওয়ার সাথে সাথে ঝড়-বৃষ্টি-শীল, নেকব্লাস্ট রোগ ও কারেন্ট পোকার আক্রমণ দেখাদেয়। এ কারণে কৃষকরা বলছে গত বছরের তুলনায় এ বছর ধান বিঘা প্রতি উৎপাদন কম হয়েছেআবার খরচও বৃদ্ধি হয়েছে। জেলার অধিকাংশ কৃষক ঋণ করে ধান চাষ করে থাকেন। এই ঋণপরিশোধ করতে কৃষকরা ধান কাটা মাড়াই শেষে দ্রুত বিক্রি করে দেন। গত মাস এপ্রিলেরমাঝামাঝি থেকে ধান কাটা মাড়াই শুরু হয়েছে।

 

এখন অধিকাংশ কৃষকদের ঘরে ধান নেই।আর শ্রমিক সংকট থাকা ও শ্রম মূল্য বেশি থাকায় বিঘায় প্রতি ধান উৎপাদনে কৃষকদেরখরচ হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার টাকা। আর ধান পাচ্ছেন বিঘা প্রতি ১৬ মণ থেকে ১৯ মণ। গতবছর একই জামিতে ২২ মণ থেকে ২৬ মণ ধান উৎপাদন হয়েছিল। নওগাঁর ধান-কেনা বেচারবিভিন্ন হাট-বাজার ঘুরে জানা গেছে, মোটা জাতের (হাইব্রিট) ধান বাজারে বিক্রিহচ্ছে সাড়ে ৪শ’ টাকা থেকে ৫শ’ ৩০ টাকায়। চিকন জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫শ’টাকা থেকে সাড়ে ৬শ’ টাকায়। বিক্রির দাম হিসেবে প্রতি বিঘা প্রায় ৪ হাজার টাকাকৃষকদের লোকসান গুণতে হচ্ছে।মহাদেবপুর উপজেলার চকগৌরী হাটে ধান বিক্রি করতে এসে ছিলেন কৃষক আজিম উদ্দিন।তিনি জানালেন, গত বছর তার তিন বিঘা জামিতে মোটা জাতের (হাইব্রিট) ধান উৎপাদনকরতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৩৭ হাজার টাকা। ধান পেয়েছিলেন প্রায় ৭৩ মন। চলতি বছর একইপরিমাণ জমিতে রোগবালাই ও শ্রমিকের দাম দিয়ে আরো চার হাজার বাড়তি খরচ হয়েছে। ঝড়ও রোগ বালাইয়ের কারণে ধান উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৫৮ মণ। বাজারে ২৮ মণ ধান বিক্রি করলেন৫শ’ ২০ টাকা দরে।

 

এই বাজার হিসেবে তার তিন বিঘায় প্রায় ১১ হাজার টাকা লোকসানগুণতে হয়েছে। এই লোকসানের কথা বলেন কৃষক মো. জলিল, রবিন ওরাউ, আবুল কাশেমসহঅসংখ্য কৃষক। এই কৃষকরা আরো বলেন, সরকারের নির্ধারিত প্রতি মণ দাম ১ হাজার ৪০টাকা নয়। প্রতি মণ ৮শ’ টাকা দরে ধান তাদের মতো কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনলে তারালাভবান হবেন। বর্তমান ধানের বাজার দরে প্রতি বিঘা প্রায় ৪ হাজার টাকা লোকসান গুণতেহচ্ছে।এদিকে ধান কৃষকদের কাছ থেকে সরসরি কেনার দাবিতে জেলায় বিভিন্ন জেলায় বামমোর্চা জোট মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ পালন করেছে। বাম নেতারা বলছেন, জেলায় ৮০ভাগ কৃষক। তারাই রক্ত জল করে ঋণ করে ধান উৎপাদন করে থাকে।

 

অথচ কৃষকদের কাছ থেকে সারাদেশে মাত্র ১ লাখ মেট্রিকটন ধান কেনা হচ্ছে। অপরদিকে চাতাল মিলারদের কাছ থেকে তখনসরকার ৩৬ টাকা কেজি দরে ১২ লাখ মেট্রিকটন চাল সংগ্রহ শুরু করেছে। এতে লাভবান হচ্ছেনচাতাল ব্যবসায়ীরা। আর কৃষকরা ধানের নায্য দাম পাচ্ছেন না। এক কেজি চাল হ্যাসকিং মিলেউৎপাদন করতে খরচ হচ্ছে ২৭ টাকা। আর অটোরাইচ মিলে ২৬ টাকা খরচ হয়ে থাকে।জেলা বাম মোর্চা নেতা ও জেলা বাসদের সমন্বয়ক জয়নাল আবেদিন জানান, জেলায় ৮০ ভাগইপ্রান্তিক কৃষক। ধান কাটা মাড়াইয়ের শুরু থেকে এই কৃষকদের কাছ থেকে সরকার ধান নাকেনায় লাভবান হচ্ছেন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ফরিয়া ও চাতাল ব্যবসায়ীরা। সরকার কৃষকদেরস্বার্থ না দেখে চাতাল মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে। সরকারের সহযোগিতায় চাতালমালিকরা লুটপাট চালাচ্ছে।জেলা বাম মোর্চার সমন্বয়ক ও সিপিবি জেলার সভাপতি অ্যাডভোকেট মহসিন রেজাজানান, এক কেজি চাল হ্যাসকিং মিলে উৎপাদন করতে খরচ হচ্ছে ২৬ টাকা। আর অটোরাইচমিলে ২৪ টাকা খরচ হয়ে থাকে। আর সরকার ৩৬ টাকা কেজি দরে চাতাল মালিকদের কাছ থেকে১২ লাখ মেট্রিকটন চাল সংগ্রহ করছে। এতে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, প্রতি কেজিতে চাতালমালিকরা ৯ টাকা থেকে ১০ টাকা লাভ করছে। অপর দিকে কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি কেজি২৬ টাকা দরে মাত্র ১ লাখ মেট্রিকটন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তকৃষিবান্ধব না হওয়ায় কৃষকরা লাভবান হবেন না। আসলে কোন কৃষকই সরকারি গুদামেই ধানবিক্রি করতে পারে না। ধান সংগ্রহ করতে পারে সরকারের আর্শীবাদপুষ্ট নেতাকর্মীরা। দ্রুতকৃষকদের কাছে থেকে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে সরাসরি ধান কেনার দাবি জানান তিনি।এতে কৃষকদের লোকসানের হাত থেকে বাঁচানো যাবে।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) আ. জা. মু, আহসান শহীদসরকার জানান, জেলায় ইরি-বোরো ধানের ব্যাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ৪ দশমিক ২মেট্রিকটন চাল উৎপাদন হয়েছে। কৃষি বিভাগের হিসেবে নওগাঁয় চলতি ইরি-বোরোমৌসুমে প্রায় ১১ লাখ মেট্রিকটন ধান উৎপাদন হয়েছে।কৃষি বিভাগ সূত্র অনুসারে ২০১২ সালে জেলায় ৫ লাখ কৃষি কার্ডধারি কৃষক রয়েছেন।সরকারি নির্দেশনা না থাকায় এরপর দীর্ঘ ৭ বছরেও আরো কোন কৃষি কার্ডের আওয়াতায়আনা হয়নি। অনেক কৃষক আছেন যাদের এই কৃষি কার্ড নেই। জেলায় মাত্র ৫ হাজার ৬শ’৩২ মেট্রিকটন ধান সংগ্রহের অনুমোদন পাওয়ায় অধিকাংশ কার্ডধারীরাই সরকারের গুদামেধান দিতে পাবেন না।নওগাঁ খাদ্য নিয়ন্ত্রক জি. এম. ফারুক হোসেন পাটোয়ারি জানান, জেলায় ৬৭ হাজার ৪শ’৮৯ মেট্রিকটন সিদ্ধ চাল, ৫ হাজার ৬শ’ ৩২ মেট্রিকটন ধান ও ৪ হাজার ৬শ’ ১৬ মেট্রিকটনআতব চালের বরাদ্দ পাওয়া গেছে।

একজন কৃষক প্রতি কার্ডে সর্বোচ্চ ৩ মেট্রিকটন ধানসরকারি গুদামের দিতে পারবেন। সকল কৃষকদের কাছ থেকে সর্বনি¤œ ৩ বস্তা থেকে ৩মেট্রিকটন ধান সংগ্রহ করা হবে। অপর প্রশ্নে তিনি বলেন, এখানে কোন প্রকার অনিয়মকরার সুযোগ দেয়া হবে না।

আপনি আরও পড়তে পারেন