কুপিয়ে ও রগ কেটে যুবক খুন

রাজধানীর মিরপুরে ইয়াবা কারবারের আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে সুমন মিয়া নামে ২১ বছরের এক যুবককে কুপিয়ে ও রগ কেটে খুন করেছে মাদককারবারিরা। গত বৃহস্পতিবার রাতে মিরপুরের অলিমিয়ারটেক ২ নম্বর কালভার্ট বটতলায় সুমনকে প্রকাশ্যে কোপায় স্থানীয় সন্ত্রাসী ও মাদককারবারি শাহীন ওরফে বল্লা শাহীন, আলমগীর ওরফে ফুটা আলমগীর, মো. মাসুম হাওলাদার, মজিদসহ অচেনা আরও দুই-তিন যুবক।

এ সময় সুমনকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে তার বন্ধু সোহেল মোল্লা। তাকেও এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। এ কা-ে গতকাল শনিবার মিরপুর থানায় হত্যামামলা দায়ের করেছেন খুন হওয়া সুমনের বাবা মো. মফিজ মিয়া।

ঘটনার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাংলাদেশ তাঁতী লীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের মিরপুর থানার সহসভাপতি কাজী জালাল উদ্দিন ওরফে গাজী ও তার ছেলে মামুন কাজীকে আটক করেছে পুলিশ। তবে গতকাল রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হত্যাকা-ে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। থানা পুলিশের পাশাপাশি ঘটনাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশও।

গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, মিরপুরের মাদক-সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন ক্ষমতাসীন দলের কয়েকটি অঙ্গ সংগঠনের প্রভাবশালী কিছু স্থানীয় নেতা। তাদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করেন বেশ কজন ব্যবসায়ী। সুমন হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে মূলত মাদক কারবারের আধিপত্য বিস্তার করাকে কেন্দ্র করে। অভিযুক্ত বল্লা শাহীন, ফুটা আলমগীর, মাসুম ও মজিদ মাদককারবারি।

তাদের প্রত্যেকের নামে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। নেত্রকোনার কলমাকান্দা শিবনগর এলাকার ছেলে বল্লা শাহীন থাকেন মিরপুরে, আলমগীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা, মাসুম থাকেন মিরপুরের মধ্য পীরেরবাগের জনতা রোডে, আর মজিদের বাড়ি আশুলিয়ার নরসিংহপুরের বাংলাবাজার এলাকায়। সূত্রমতে, নিহত সুমনও মাদক কারবারে যুক্ত ছিলেন।

তার নামে কাফরুল থানায় একটি মাদক মামলা রয়েছে। সুমন সপরিবারে মিরপুরের বোম্বাইগলি এলাকায় ১৩৬/১ নম্বর সানোয়ারের বাড়িতে থাকতেন। ঘটনার দুদিন আগে ডিবি পুলিশ ইয়াবা ট্যাবলেটসহ মিরপুর থেকে এক মাদককারবারিকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন মিরপুর থানা পুলিশ সন্দেহভাজন এক কিশোর মাদককারবারিকে আটক করে। তারা মিরপুরের মজিদ ও মামুন গ্রুপের হয়ে কাজ করে।

এই দুটি গ্রুপ ধারণা করে, সুমন মিয়াই ওই দুজনকে ধরিয়ে দিয়েছে। এর পর মাদক কারবারে জড়িত ‘বিশ্বাসঘাতকদের’ কড়া মেসেজ দিতে সুমনকে হত্যার পরিকল্পনা করে তারা। কলকাঠি নাড়েন ক্ষমতাসীন দলের একাধিক স্থানীয় নেতা। হত্যাকা-ের পর খুনিদের আত্মগোপন রাখা, অর্থের জোগান থেকে শুরু করে পালানো পর্যন্ত সব কিছুর দেখভাল করেন তারাই।

খুনের পর ৩ খুনি পালায় ৩ জেলায়। বর্তমানে মোবাইল ফোন বন্ধ রাখায় তাদের অবস্থান শনাক্তে বেগ পেতে হচ্ছে তদন্তসংশ্লিষ্টদের। এক খুনির অবস্থান প্রথম দিকে শনাক্ত করা গেলেও এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। নিহত সুমনের বাবা মফিজ মিয়া আমাদের সময়কে জানান, আহত সোহেল মোল্লার অধীনে ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করত সুমন। আগে মামলায় অভিযুক্তদের সঙ্গে তার ছেলের চলাফেরা ছিল। অভিযুক্তরা সুমনকে মাদক ব্যবসা করার জন্য বললে সুমন রাজি না হয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এতে বিরোধ সৃষ্টি হয় মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে।

বৃহস্পতিবার আসরের আজানের পর একটি ফোন কল পেয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় সুমন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে সুমন ও সহকর্মী বন্ধু সোহেল পিঠা খেতে অলিমিয়ারটেক ২ নম্বর কালভার্ট বটতলায় গেলে বল্লা শাহীন, ফুটা আলমগীর, মাসুম ও মজিদসহ ২ থেকে ৩ মাদক ব্যবসায়ী অতর্কিত হামলা করে। এ সময় শাহীন ও আলমগীর চাকু দিয়ে সুমনকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। হাত-পায়ের রগ কাটা ছাড়াও শরীরে অন্তত ৪০টি আঘাত করে। একপর্যায়ে সুমনকে বাঁচাতে তার বন্ধু সোহেল এগিয়ে গেলে তাকেও এলোপাতাড়ি কোপায়।

তাদের চিৎকারে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে পালিয়ে যায় খুনিরা। সব কিছুই ঘটে প্রকাশ্যে। পরে সুমন ও সোহেলকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সুমনকে মৃত ঘোষণা করেন। অবস্থার অবনতি হলে রাতেই সোহেলকে স্থানান্তর করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে লাশের ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার রাতে সুমনের মরদেহ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।

পুলিশ আহত সুমন ছাড়াও তাঁতী লীগের স্থানীয় এক নেতা ও তার ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে বলে জানতে পেরেছেন মফিজ মিয়া। ছেলের খুনিদের ফাঁসি দাবি করেন সুমনের বাবা। নিহতের মা রাজিয়া বেগম জানান, ঘটনার দুদিন আগে সুমন তাকে বাসা ছেড়ে মুন্সীগঞ্জ চলে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। কারণ জানতে চাইলে বলেন  ঢাকায় থাকলে ওরা তাকে মেরে ফেলবে।

কারা মারবে প্রশ্ন করলে রাজিয়া বেগমকে সুমন বলেন, নেতারা। মিরপুর থানার ওসি দাদন ফকির বলেন, এই হত্যাকা-ে অভিযুক্তরা এবং ভিকটিম সুমন সবাই মাদক কারবারে জড়িত। মাদক নিয়ে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে এই হত্যাকা- ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় শনিবার হত্যা মামলা হয়েছে। কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে সুমনের খুনিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।

আপনি আরও পড়তে পারেন