রেলপথের স্লিপার যেন ‘মৃত্যু ফাঁদ’

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণহানী ঘটে চার জনের। এ ঘটনায় আহত হন দুইশতাধিক।

ঘটনার তিনদিন পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন দুই মন্ত্রী। নিহতদের এক লক্ষ টাকা ও আহতদের ১০ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা দেন রেলমন্ত্রী। এদিকে এ ঘটনার পর বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় আখাউড়া-সিলেট রুটের নানা সমস্যা সামনে এসেছে। সাথে রেলওয়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগও আসছে বেশি করে। সাংবাদিকদের পেলেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান স্থানীয়রা।

সাংবাদিকদের নিয়ে স্টেশন এলাকায় ট্রেন লাইনে সংযোগস্থল দেখান। লক্কড়-ঝক্কড় দু’টি রেলের সংযোগস্থলে স্লিপারের সঙ্গে ৮টি ক্লিপ থাকার কথা থাকলেও কোথাও একটি আবার কোনো কোনো সংযোগস্থলে ক্লিপ নেই। তাছাড়া রেলের সঙ্গে স্লিপারের ক্লিপ নেই। রেলের স্লিপারের মধ্যে পাথর নেই। ঘাসে আচ্ছাদিত পাথর।

সরজমিন দেখা যায়, এই রুটের রেলসেতু ও কালভার্টগুলোর অর্ধশত বছরের পুরনো কাঠের স্লিপারের অধিকাংশ বিনষ্ট হয়ে গেছে, লাইনের ক্লিপ চুরি হওয়া ও পাথর সরে যাওয়ার কারণেই দীর্ঘদিন থেকেই ‘মরণফাঁদে’ পরিণত হয়েছে রেলপথ। এছাড়া মেয়াদ উত্তীর্ণ বগি ও ইঞ্জিন তো আছেই। খোদ রেল বিভাগই স্বীকার করে এ ভয়াবহ চিত্রের কথা। এছাড়া রেললাইনের ক্লিপ-হুক উঠে যাওয়া, সেতু-কালভার্ট সংস্কারের অভাবে ও রেলসেতুর কাঠের স্লিপারগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে এ রেলপথটি। এছাড়া রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ‘মোটর-ট্রোলি’ করে লাইন চেকে গাফিলতির ফলে নানা ত্রুটি অজানা থাকায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরী হয় প্রতিনিয়িত। এমনকি বাঁশ দিয়ে মেরামত করা হয়েছে রেলসেতু।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ৭০ থেকে ১০০ বছরের কিংবা তারও বেশি পুরনো সেতুগুলো শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, চরম আতঙ্কেরও বটে। এছাড়া স্টিল কিংবা লোহার ব্রিজগুলো আরো ঝুঁকিপূর্ণ। সেতুগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশেরই মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের মতে, নির্মাণের ৫০-৫৫ বছর পর সেতুর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।

রেলওয়ে সূত্রে আরও জানা যায়, সিলেট-কুলাউড়া-আখাউড়া সেকশনে ১৭৮ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। ১৭৬ কিলোমিটারের ঢাকা-সিলেট রেলপথটি ব্রিটিশ আমলের তৈরি। ঢাকা থেকে ভৈরব পর্যন্ত ডাবল লাইন স্থাপন করা হলেও ভৈরব থেকে সিলেট পর্যন্ত রাস্তাটি রয়েছে অনেক ঝুকিপূর্ণ অবস্থায়। দীর্ঘ এ পথে ছোট-বড় ২৫০টির বেশি সেতু রয়েছে। সর্ব নিন্ম তিন ফুট থেকে ৩০০ ফুট দীর্ঘ পর্যন্ত সেতুগুলো ৬০-৭০ বছর আগে নির্মিত। প্রতিদিন এই রেলপথে ৬ জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন এবং ৭টি লোকাল ট্রেনসহ কয়েকটি পণ্যবাহী ট্রেনও চলাচল করে।

সরেজমিনে কুলাউড়া উপজেলার দুর্ঘটনাকবলিত বরমচাল এলাকায় অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই রেলের শতকরায় ৪০ টি ক্লিপই নাই। অনেক জায়গায় টাই প্লাট ভাঙা, কোথাও আবার আরসিসি স্লিপার ভাঙা ও কাঠের স্লিপার পচে গেছে। এমনও দেখা গেছে একটি স্লিপারের কোনো মাথায় ক্লিপস নেই। মানে টান দিলে স্লিপার বের করে আনা যাবে। একই চিত্র টিলাগাঁও, লংলা ও কুলাউড়া স্টেশন এলাকায়। এছাড়া কয়েকটি সেতু পরিদর্শন করে দেখা যায়, সেতুগুলোর গার্ডারের অবস্থা জরাজীর্ণ। সেতুর মধ্যে স্লিপার বেঁকে আছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, রেলওয়ের বিধান অনুযায়ী ‘মোটর-ট্রোলি’ করে লাইন পরীক্ষা করা কথা। কিন্তু কুলাউড়া স্টেশন থেকে সিলেট অভিমুখে বা শ্রীমঙ্গল স্টেশন অভিমুখে এ ধরণের কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়না। যার ফলে লোহা ব্যবসায়ীরা রেললাইনে স্পাইক খোলার বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করে টাই প্লাট, ক্লিপস ও ফিসপ্লেট খুলে নিয়ে যান। খাটি লোহার এসব সরঞ্জামের চড়া দাম থাকায় প্রতিনিয়ত তা চুরি হচ্ছে। রেলওয়ের টহল ও মোটর-ট্রোলি’ না থাকায় নির্বিঘ্নে তারা এসব চুরি করতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের কুলাউড়া স্টেশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই রেলপথের যন্ত্রাংশ পুরনো হওয়াতে ট্রেন চলাচলের সময় ক্লিপ-হুক স্লিপার ও রেললাইন থেকে ছুটে ওড়ে যায়। কাঠের স্লিপার পরে যাওয়াতে ট্রেনের চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেক স্লিপার বেকে যায় এতে লাইন দুর্বল হয়ে পড়ে।

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) মো. আব্রার হোসেন জানান, পূর্বা ল রেলওয়েতে ১ হাজার ৬৩৯টি ব্রিজ রয়েছে; যার প্রায় ৮৫ শতাংশই ব্রিটিশ আমলের। এসব ব্রিজের কোনোটাই রড-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি নয়। পাথর দিয়ে তৈরি এসব ব্রিজ বছরের পর বছর ধরে মেরামত করতে হয়। এত পুরনো ব্রিজ মেরামত করেও যথাযথ করা সম্ভব হয় না।

রেলওয়ের পূর্বা লীয় প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল জলিল বলেন, আমাদের লোকেরা নিয়মিত লাইন পরিদর্শন করার কথা। কোথাও যদি সেটি না হয়ে থাকে তাহলে সেই লাইনের যেসব ত্রুটি তৈরি হবে তার দায় দায়িত্বরতদের উপর বর্তায়। আমরা এখন এই রুটের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি।

আপনি আরও পড়তে পারেন