নতুন বাস নাকি মুড়ির টিন!

ভারতীয় ঋণে (এলওসি) দেশটি থেকে বিআরটিসির জন্য কেনা বাসে ত্রুটি দেখা গিয়েছে। মাত্র দুই মাস আগে দেশে আসা ভারতীয় কোম্পানি টাটার বাসে বৃষ্টির পানি পড়ছে ছাদ ফুটো হয়ে। গাবতলী ডিপোতে গত ১৬ এপ্রিল এবং ১০ মে দেওয়া আটটি নতুন বাসেই দেখা দিয়েছে সমস্যা।

বাসের বডিতে যে মানের শিট দেওয়ার কথা ছিল, দেওয়া হয়নি তা। পাতলা শিট দেওয়া হয়েছে। বাস দেশে আনার আগে কয়েক দফায় ক্রয়-পূর্ব পরিদর্শন করেছিলেন বিআরটিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বিআরটিসি যে মানের (স্পেসিফিকেশন) বাস চেয়েছিল, সেই মানের বাস দেওয়া হচ্ছে কি-না, তা দেখতেই পরিদর্শন। বিআরটিসি সূত্র জানিয়েছে, পরিদর্শনে সমস্যা ধরা পড়েছিল। কিন্তু সমস্যা জেনেও বাসগুলো আনা হয়।

গত ১৫ জুন বিআরটিসির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বাসে ত্রুটির কথা জানিয়ে চিঠি দেন গাবতলী ডিপো ম্যানেজার মো. মনিরুজ্জামান। বিআরটিসি চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়াকে দেওয়া এ চিঠিতে বলা হয়েছে- ‘গাড়িগুলোর ছাদ দিয়ে বৃষ্টির সময় ভেতরে পানি পড়তে দেখা যায়। কারণ অনুসন্ধান করে দেখা যায়, বাসের ছাদে যে এমএস শিট দেওয়া হয়েছে, তা অতিমাত্রায় পাতলা। শিট ছিঁড়ে ভেতরের রিভিট বের হয়ে এসেছে। যার কারণে রিভিটের ছিদ্র দিয়ে পানি ঢুকে সিলিং বেয়ে পানি ভেতরে পড়ছে। এমএস শিট রিভিট থেকে আলগা হওয়ায় গাড়ি চলার সময় বিরক্তিকর শব্দ সৃষ্টি হয়।’

বিআরটিসি চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া এ অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি সমকালকে বলেছেন, বাসগুলোতে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, বাসের ইঞ্জিন টাটার তৈরি হলেও, বডি এসিজিএল গোয়া নামের একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের তৈরি। চুক্তি অনুযায়ী, তারা দুই বছর বিক্রয়োত্তর সেবা দেবে। তাদের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছে। তারা বাংলাদেশে এসে সমস্যার সমাধান করে দেবে।

ভারত থেকে কেনা বাসগুলোর আয়ুস্কাল ধরা হয়েছে ২০ বছর। কিন্তু মাত্র দুই মাসের মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু একে বড় সমস্যা বলে মনে করছেন না বিআরটিসির চেয়ারম্যান। তিনি ছাদ ফুটোকে ‘সামান্য সমস্যা’ বলেছেন সমকালকে।

ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেছেন, সমস্যার কথা জেনে তারা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছেন। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। বাস সরবরাহ করা প্রতিষ্ঠানের বিলের ২০ শতাংশ এখনও পরিশোধ করা হয়নি। বিল আটকে দিতে ভারতের এক্সিম ব্যাংককে জানানো হয়েছে।

তবে এ ব্যবস্থাকে অগ্রহণযোগ্য বলছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি সমকালকে বলেছেন, ‘নতুন কেনা বাসে দুই মাসেই সমস্যা দেখা দিয়েছে, এর মানে যারা প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশনে (ক্রয়-পূর্ব পরিদর্শন) ভারত গিয়েছিলেন, তারা ঠিকঠাকমতো বাসগুলো পরীক্ষা করে দেখেননি! বিদেশ ঘুরেফিরে চলে এসেছেন। বাংলাদেশে সরকারি কেনাকাটায় এ অনিয়ম নতুন নয়। বিআরটিসির জন্য আগে কেনা বাসগুলোও এ কারণে টেকেনি।’

২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় বাংলাদেশকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে চুক্তি হয়। এ চুক্তিতে ৫৮১ কোটি টাকায় ৬০০ বাস এবং ২১৭ কোটি টাকায় ৫০০ ট্রাক কেনা হয় ভারত থেকে। গত ডিসেম্বর থেকে বাস-ট্রাক আসা শুরু হয়। শেষ ধাপে আসার অপেক্ষায় থাকা বাস-ট্রাকের ক্রয়-পূর্ব পরিদর্শনে গতকাল শুক্রবার বিআরটিসির আরেকটি প্রতিনিধি দল ভারত গেছে।

চুক্তি অনুযায়ী, ভারত থেকে অশোক লিল্যান্ডের ৩০০ দ্বিতল, ২০০ একতলা এসি বাস কেনা হয়। কেনা হয়েছে টাটার ১০০ নন-এসি বাস। বিআরটিসির কারিগরি শাখার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেছেন, তারা ভারত থেকে বাস কিনতে রাজি ছিলেন না। কারণ, ভারতের বাসের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাদের ইচ্ছা ছিল জাপানের বাস কেনার। কিন্তু এলওসি চুক্তি অনুযায়ী, ঋণের টাকায় ভারত থেকে বাস কেনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই এসব কেনা হয়েছে।

বাসগুলোর ক্রয়-পূর্ব পরিদর্শনে বিআরটিসির চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় ভারতে যান। বিআরটিসির একজন ম্যানেজার সমকালকে বলেছেন, তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাস পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তাড়াহুড়ার কারণে তা পারেননি।

তবে এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন বিআরটিসির মহাব্যবস্থাপক (কারিগরি) মেজর আলিমুর রহমান। তিনি সমকালকে বলেছেন, ক্রয়-পূর্ব পরিদর্শনে তারা ২৩/২৪টি সমস্যা পেয়েছিলেন বাসগুলোর। সেগুলো সারতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়। তারা তা করেও দেন। বাস আনার আগে ‘শাওয়ার টেস্ট’ও করা হয়েছিল। তখন বাসের ছাদ দিয়ে পানি পড়েনি। দেশে আনার পর কী কারণে এ সমস্যা হয়েছে, তা দেখে সমাধান দিতে সরবরাহকারীদের ডাকা হয়েছে।

ডিপো ম্যানেজার মো. মনিরুজ্জামান নতুন কেনা বাসের ত্রুটির বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেছেন, তিনি যেসব সমস্যা দেখতে পেয়েছেন পরিচালকের (কারিগরি) মাধ্যমে চেয়ারম্যানকে জানানো হয়েছে। পরিচালক (কারিগরি) কর্নেল মাহবুবুর রহমান নতুন বাসে ত্রুটির কারণ সম্পর্কে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। তিনি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

বিআরটিসির একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে বলেছেন, অশোক লিল্যান্ডের বাসগুলোতেও সমস্যা রয়েছে। বাসের বডি সামান্য আঘাতে দেবে যায়। বাসের আসনগুলোও নিম্নমানের। যে মানের পর্দা, ফ্যান দেওয়ার কথা ছিল, তা দেওয়া হয়নি। বাসের নিচের বডিতে কাঠ দেওয়া হয়েছে। স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী স্টিল বার দেওয়ার কথা। ইঞ্জিনের অবস্থা কেমন তা এখনও বলার সময় আসেনি।

তেজগাঁও ট্রাক ডিপোর একাধিক চালক সমকালকে জানিয়েছেন, ভারত থেকে আনা ট্রাকগুলোতেও সমস্যা রয়েছে। ট্রাকে টুলবক্স দেওয়া হয়নি।

বিআরটিসির জন্য গত এক দশকে কেনা সব বাস নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ২০০৯ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত এ পরিবহন করপোরেশনের জন্য ১২২ কোটি টাকায় ২৭৯টি বাস কেনা হয়। ১২৫টি সচল রয়েছে। বাকিগুলো ডিপোতে অচল পড়ে রয়েছে। ২০১৩ সালে ২৮২ কোটি টাকায় আনা হয় দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু কোম্পানির ২৫৫টি বাস। প্রতিটি বাসের দাম পড়ে কোটি টাকার বেশি। কারিগরি শাখার তথ্যানুযায়ী, ছয় বছর পার না হতেই ৮১টি বাস নষ্ট হয়ে পড়েছে। এগুলো মেরামত অযোগ্য। ২০১৩ সালে ভারত থেকে কেনা আর্টিকুলেটেড বাসের ৩৩টি বিকল হয়ে গেছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন