রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরাতে একমত চীন

রোহিঙ্গা সংকটের ‘দ্বিপক্ষীয় সমাধানে’ চীনের সহযোগিতার আশ্বাস নিয়ে আজ শনিবার দেশে ফিরছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের গণবাস্তুচ্যুতি ও মানবতার চরম বিপর্যয়ের পর প্রথমবারের মতো চীন সফরের সুযোগে ওই দেশটির নেতাদের কাছে পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন তিনি। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশকে আলোচনার মাধ্যমেই এ সংকট সমাধান করতে বলার পাশাপাশি প্রয়োজনে সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন চীনের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।

চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াংয়ের পর গতকাল শুক্রবার প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং ও ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) আন্তর্জাতিক বিষয়ক মন্ত্রী সং তাওও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তাঁরা নিশ্চিত করেছেন, চীন রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান চায়। রোহিঙ্গাদের নিজেদের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়েই এ সংকটের সমাধান।

চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল শুক্রবার বেইজিংয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুই নেতা একমত হয়েছেন যে এটার (রোহিঙ্গা সংকট) দ্রুত সমাধান করতে হবে। এটাকে আর ফেলে রাখা যাবে না। দুই বছর হয়েছে চুক্তি হয়েছে। সুতরাং ওই ব্যাপারেও কোনো দ্বিমত নেই।’

নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে প্রায় দুই বছর ধরে। তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও তার বাস্তবায়ন করেনি।

এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার ভার বয়ে চলা বাংলাদেশের সরকার মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির জন্য কূটনৈতিক যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন আগেই জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর এবারের চীন সফরে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ প্রাধান্য পাবে।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষামতাধারী চীন বরাবরই আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে এসেছে।

তবে প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায় রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে চীনের উদ্যোগী হওয়ার প্রতিশ্রুতি পাওয়ার কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব। রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফিরতে পারার মতো পরিবেশ তৈরিতে চীন মিয়ানমারকে রাজি করানোর পদক্ষেপ নেবে বলে লি খ্য ছিয়াং বৈঠকে প্রতিশ্রুতি দেন।

এরপর শুক্রবার দুপুরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কিত মিনিস্টার সান তাও তাদের দলের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রতিশ্রুতি দেন। বিকালে বেইজিংয়ের দিয়ায়োতাই স্টেট গেস্ট হাইজে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসেন শেখ হাসিনা। দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয়ে সঙ্গে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টি তাদের আলোচনায় গুরুত্ব পায়। পরে শি চিনপিংয়ের দেওয়া নৈশভোজেও অংশ নেন শেখ হাসিনা।

আলোচনার বিষয়ে জানাতে গিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশ এখন ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। এটা যে বাংলাদেশের জন্য একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে পরিবেশ ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে, এটা প্রধানমন্ত্রী চীনা প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা যাতে দ্রুত মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে সেজন্য চায়নিজ সরকার ও প্রেসিডেন্টের গুডউইল আশা করছি আমরা। চীনের প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, চায়না আগেও এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সাথে কাজ করে যাচ্ছিল এবং এখনো কাজ করে যাবে। উনাদেরও উদ্দ্যেশ্য- যাতে রোহিঙ্গারা দ্রুত তাদের দেশে ফিরে যেতে পারে।

পররাষ্ট্র সচিব বলেন, মিয়ানমারের যে মন্ত্রী রোহিঙ্গাদের বিষয়টি দেখেন, তিনি শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করতে পারেন বলে চীন সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, হয়তো আরেকটা সম্ভাবনা দেখা দেবে। শি চিং পিংয়ের কিছু প্রশ্ন ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুন্দরভাবে সমস্যাটার বিভিন্ন অবয়ব তুলে ধরেছেন। তারা একমত হয়েছেন যে, দ্রুত এটার সমাধান করতে হবে।

শহীদুল হক বলেন, দুই দেশের প্রতিনিধিবৃন্দ এখন একত্রে কাজ করবে এবং তারাও মিয়ানমারের ওপরে তাদের গুডউইল ব্যবহার করবে। বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি আছে যে, মিয়ানমারে ফিরে গেলে আবার তাদের ওপর অত্যাচার হতে পারে। সে কারণেই তারা ফিরতে আগ্রহী হচ্ছে না। এ বিষয়ে চীন যেন তাদের ‘গুডউইল’ ব্যবহার করে, সেই অনুরোধ তিনি শি চিন পিংকে করেন।

জবাবে চীনা প্রেসিডেন্ট বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরের মধ্যে আছে। ফলে ওই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার ‘সম্ভাবনা খুবই কম’ বলে তিনি মনে করেন।

পররাষ্ট্র সচিব বলেন, চীনের পক্ষে যতটুকু সম্ভব সেই চেষ্টা তারা করবেন বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং। উনারা বলেছেন, চায়নার কাছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুজনেই বন্ধু। কেউ কম কেউ বেশি না, দুজনেই সমান বন্ধু। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চায়না দুজনের স্বার্থই দেখবে- এটা তিনি নিশ্চিত করেছেন।। শেখ হাসিনার সঙ্গে শি চিন পিংয়ের ‘সত্যিকারের বন্ধুত্ব’ অব্যাহত থাকবে বলেও বৈঠকে প্রতিশ্রুতি দেন চীনের প্রেসিডেন্ট।

শহীদুল হক বলেন, শি চিন পিং যখন নৈশভোজ শেষে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন, তখন উনি বলেছেন, পরস্পরের প্রতি আমরা সত্যিকারে বন্ধু হয়েই থাকব। এটা থেকে ওভারঅল দুই নেতৃত্বের মধ্যে যে সম্পর্ক, সেটা প্রকাশ পায়।

বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক ২০১৪ থেকে মোট তিন দফা এ দুই নেতার বৈঠকে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছেন।

এবারের বৈঠকের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, একটা ডিফরেন্ট ইক্যুয়েশন এবং কেমিস্ট্রি প্রকাশ পেয়েছে। সেটা বিশেষ করে ডিনারের সময়, একটা ইনফরমাল সিটিংয়ে অত্যন্ত হৃদ্যতার সাথে আলোচনা হয়েছে। একইসাথে আমরা দেখেছি, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব ম্যাচিউরড ন্যারেটিভ এসেছে। যেমন শি চিন পিং বলেছেন, বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। আমরা দুই প্রতিবেশীই উন্নয়নের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফেইজে আছি।

শি চিন পিং বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন জানিয়ে শহীদুল হক বলেন, বাংলাদেশেরও চায়নার থেকে শেখার আছে। চায়নারও বাংরাদেশ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে এই উন্নয়নের। দুই নেতাই বারবার গুরুত্ব আরোপ করেছেন যে, আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হল জনগণের উন্নয়ন। শি চিন পিং বারবার বলেছেন, আমাদের কিছু অভিন্ন বোঝাপড়া আছে, এটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক লেভেলে। আমরা একে অন্যের প্রাধান্য, চ্যালেঞ্জগুলো বুঝতে পারি। পররাষ্ট্র সচিবের ভাষায়, এটাই একটি সম্পর্কের পরিপক্কতার অভিব্যক্তি। চায়না বলেছে যে, বাংলাদেশের উন্নয়নের সাথে চায়না সবসময় আছে এবং সবসময় থাকবে। দিনের পর দিন এটা আরো গভীর ও শক্তিশালী হবে। দুজনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, সম্পর্ক যেন আরো উচ্চতায় যায় সেজন্য উনারা চেষ্টা করবেন।

চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ ছাড়াও চারটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে বাংলাদেশে চীনাদের আরও বিনিয়োগ করা উচিৎ বলে বৈঠকে মন্তব্য করেছেন শেখ হাসিনা। চাইনিজ প্রেসিডেন্ট খুবই সেনসেটিভভাবে এই জিনিসটা গ্রহণ করেছেন এবং উনি বলেছেন, আমরা এ ব্যাপারে অবগত। আমরা সব ধরনের চেষ্টা করব, যাতে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসে।

ডেল্টা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ জলবায়ু অভিযোজন কেন্দ্র স্থাপন এবং তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিস্টোরেশন প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের সহায়তা চান শেখ হাসিনা। জবাবে শি চিন পিং বিষয়গুলো বিবেচনা করার আশ্বাস দেন।

চীনের জন্য বাংলাদেশে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হয়েছে জানিয়ে অন্যান্য অর্থনৈতিক অঞ্চলেও চীনা বিনিয়োগের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জবাবে প্রেসিডেন্ট শি বলেন, তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য চীনের বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করছেন।

পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ২০১৬ সালে শি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় যে ২৭টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল সেগুলোর বাস্তবায়ন তরান্বিত করা এবং ঋণের শর্তগুলো ‘একটু সহজ’ করার অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রী। দুই নেতাই জাতিসংঘে একসঙ্গে কাজ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন। বিসিআইএম করিডোরের ওপর খুব গুরুত্বারোপ করেছেন। তারা বলেছেন, ইন্ডিয়ার সাথে যৌথভাবে কাজ করে বিসিআইএম করিডোরটা জীবন্ত করতে হবে। তাতে বাংলাদেশ, চায়না, ইন্ডিয়া ও মিয়ানমারের জন্য নতুন একটা বাজার উন্মোচিত হবে।

বাংলাদেশের অটিজম বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমও এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। নৈশভোজের পর দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরাও বৈঠক করেন। সেখানেও রোহিঙ্গা সঙ্কটসহ বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার নজরুল ইসলাম এবং চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ফজলুল করিম ব্রিফিংয়ের সময় উপস্থিত ছিলেন।

আপনি আরও পড়তে পারেন